নাশতার টেবিলে সাংবাদিক সামনে পেয়ে এক খেলোয়াড়ের অনুযোগ, ‘ভাই, লজ্জাজনক ব্যাটিং কথাটা না লিখলেও পারতেন।’ প্রতিবাদ এল পাশে বসা সতীর্থের কাছ থেকে, ‘কেন লিখবে না? সত্যি কথাই তো লিখেছে…।’
সব খেলোয়াড়ের মনের কথা পড়া কঠিন। তবে শরীরী ভাষার অনুবাদ যদি সঠিক হয়ে থাকে তাতে ‘হেরেছি তো কী হয়েছে’ জাতীয় থোড়াই কেয়ার ভাব কারও কারও মধ্যে আছেই।আবার জিম্বাবুয়ের কাছে এভাবে চার দিনে হেরে যাওয়া এবং দুই ইনিংসেই ধসে পড়া ব্যাটিং যে আসলেই বড় লজ্জার, সেই বিব্রতভাবও আবিষ্কৃত অনেকের মধ্যে।প্রিমিয়ার লিগ শুরু আর বিপিএলের বকেয়া পাওনার দাবিতে ঢাকায় খেলোয়াড়দের আন্দোলন-বিষয়ক আলোচনাও হারারের বাতাস থেকে খুব বেশিক্ষণ সরিয়ে রাখতে পারছে না এই যন্ত্রণার অনুভূতি।
পরশু রাতে লম্বা টিম মিটিং হয়েছে হোটেলে। নরম-সরম মানুষ শেন জার্গেনসেনও সেখানে রাগ সামলাতে পারেননি বলে খবর। ক্ষুব্ধ কোচ নাকি গ্রায়েম ক্রেমারের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের তুলনা দিয়ে বলেছেন, ‘যে বোলারের বোলিং গড় ৪৩ সে তোমাদের সঙ্গে ৪ রানে ৪ উইকেট নেয়! যার ব্যাটিং গড় ১০, তাকে তোমাদের দুই ইনিংসে আউট করতে লাগে ২৪৩ বল!’
কিন্তু কেন হঠাৎ এমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল দলের পারফরম্যান্স? শ্রীলঙ্কা সফরের সাফল্যজনিত আত্মবিশ্বাসে দলের উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চেহারা আফ্রিকার অরণ্যে এভাবে হারিয়ে গেল কেন! বলতে পারেন, একটা টেস্টেই তো হেরেছে। এ নিয়ে শোকগাথার তো কিছু নেই! হ্যাঁ, খেলায় হারজিত থাকে। আজ হেরেছে, কাল হয়তো জিতবে। আসলে প্রতিপক্ষ দলটা ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা হলে এই যন্ত্রণার উপশম হতো। দলটা যে জিম্বাবুয়ে! তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশের লড়াই অনেক দিন ধরেই মর্যাদার। সেই জিম্বাবুয়ের কাছেই এক দিন বাকি থাকতে ৩৩৫ রানের বিশাল হার এবং দুই ইনিংসেই ব্যাটিং ব্যর্থতাও যদি মনে অপমানের জ্বলুনি না ধরায়, তাহলে যে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সামর্থ্যকেও ছোট করা হয়! আর এমন বাজে শুরুর পর ২০১১ সালের সফরে কী হয়েছিল তা সবারই জানা। প্রথম টেস্টের বিপর্যয় এবারও পুরো সফরটাকেই না কালো মেঘে ঢেকে দেয়, এখন তো সেই শঙ্কাও জাগছে।
কেন এমন ব্যাটিং? আরেকটু ভালো কি হতে পারত না! সাকিব আল হাসান প্রথমে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত অন্তত নিজের কথাটা বললেন, ‘অন্যরা কেন খারাপ ব্যাটিং করেছে আমি জানি না। আমি শুধু আমারটা বলতে পারি। ছয় মাস আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে ছিলাম, হয়তো এটাই কারণ। তবে সুস্থ সবলভাবে টেস্ট শেষ করতে পারাটাই বড় কথা আমার জন্য।’ আরেক বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র টেস্টে ফিরেছেন প্রায় চার বছর পর। প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট প্রত্যাবর্তন টেস্টে কিছুটা তৃপ্তি দিলেও দ্বিতীয় ইনিংসে নিজের বোলিং নিয়ে খুশি হতে পারছেন না নিজেই। সঙ্গে আছে লজ্জাজনক হারের জ্বালাও। এনামুলের ধারণা, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলার চিরকালের চাপ আর এখানকার কন্ডিশনই ডুবিয়েছে তাঁদের। তবে তাঁর আশা, ২০১১ সালের মতো বাজে অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্তত ফিরতে হবে না এবার, ‘ভাগ্য ভালো যে এবার দুটি টেস্ট খেলব। আগেরবার তো একটা টেস্ট ছিল। এবার দুটি টেস্ট হওয়াতে ফিরে আসার সুযোগ আছে।’
প্রথম ইনিংসে ৩৮ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে একমাত্র মোহাম্মদ আশরাফুলের ব্যাটেই নির্ভরতা খুঁজে পাচ্ছিল বাংলাদেশ। সেটা এতটাই যে দলের সঙ্গে আসা নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীনও মুগ্ধ। কিন্তু সেই মুগ্ধতা পরক্ষণেই হোঁচট খায় আশরাফুলের অদ্ভুত রানআউটের ছবিটা চোখে ভেসে উঠলে। যে রানআউটের জন্য নিজেকে নিজেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন আশরাফুল, ‘পাঁচ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও ভেবেছিলাম নাসিরের সঙ্গে বড় জুটি করব। সেভাবেই খেলছিলাম। কিন্তু হঠাৎ যে কী হলো! কিছু বুঝেই উঠতে পারলাম না।’
জিম্বাবুয়ের কন্ডিশন আর বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতার পাশে আরেকটা প্রসঙ্গ আনতেই হচ্ছে। বাজে আম্পায়ারিংয়ের অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারে এই টেস্টের আম্পায়ারিং। প্রথম ইনিংসে জহুরুল ইসলাম আর মুশফিকুর রহিমের এলবিডব্লু নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে জহুরুলের কট বিহাইন্ডটা যে হয়নি, সেটা নিয়ে কোনোই সংশয় নেই। জহুরুলের দুঃখটা বেড়েছে যখন আম্পায়ার নিজেও ভুল স্বীকার করেছেন। অন্য প্রান্তে থাকা আশরাফুল আউটটা হয়নি জানালে আম্পায়ার নাকি অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন মাঠেই। পরে ব্যাপারটা গড়িয়েছে মাঠের বাইরেও। পরশু খেলা শেষে আম্পায়ারিং নিয়ে ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রডের কাছে ক্ষোভ জানিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের কোচ।
বাজে আম্পায়ারিং হতেই পারে, কিন্তু সেটার শিকার বারবার বাংলাদেশই কেন? অবশ্য হারের ব্যবধানটা যখন ৩৩৫ রানের, আম্পায়ারিং নিয়ে অভিযোগ তুলে কেবল ভবিষ্যতের জন্য তাদের সতর্কই করা যায়। পরাজয়ে সান্ত্বনা খোঁজা যায় না।
(২২ এপ্রিল/২০১৩)নিউজরুম.