বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার এক দশক ধরে সোয়া ৬ শতাংশের চক্রে আটকে গেছে। চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার সরকারি লক্ষ্যমাত্রা থেকে যে অনেকটাই পিছিয়ে থাকবে, তা মোটামুটি নিশ্চিত। আর তাই এক দশকের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ২৫ শতাংশে থেকে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। এর মানে হলো, নানা চেষ্টা সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধির হারকে ৭ শতাংশেই উন্নীত করা যাচ্ছে না। তার ওপরে যাওয়া তো দূরে থাক।
বর্তমান সরকার মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কর্মকাঠামোয় প্রবৃদ্ধির হার ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।স্বাভাবিকভাবে এই পর্যায়ে যেতে হলে আগে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশে যেতে হবে।চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ২০ শতাংশ আর আগামী বছরের (২০১৩-১৪) জন্য ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। মধ্যমেয়াদি কর্মকাঠামোর প্রক্ষেপণ অনুসারে ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল।বাস্তবে আর তা সম্ভব হয়নি। ৬ দশমিক ৩০ শতাংশেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। যে বাস্তবতায় এ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, তাতে এ হার খারাপ বলার অবকাশ কম।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকেরা অবশ্য ৬ শতাংশের ওপরে থাকা প্রবৃদ্ধির হারকে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বিরাট অর্জন হিসেবে দেখছেন। তাঁদের দাবি, খুব কম দেশেই সাম্প্রতিক সময়ে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।সে বিবেচনায় বাংলাদেশের অর্জন অবশ্যই বেশ ভালো। এই কথায় যুক্তি আছে বৈকি! তবে সেটা পুরোপুরি গ্রহণ করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাও যে অর্থনীতির অগ্রগতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, তা সবারই জানা। আর অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাও নানা ধরনের দুর্বলতা ও বিশৃঙ্খলার জালে জড়িয়ে নাজুক হয়ে গেছে। বিশেষ করে আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারি ও অনিয়ম স্পষ্টত প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলেছে।
যেহেতু বাজেটের সময় ঘনিয়ে আসছে, সেহেতু প্রবৃদ্ধিও আলোচনায় চলে আসছে। মোটা দাগে বললে, বাজেট কতটা বাস্তবায়িত ও কার্যকর হলো, তার একটি প্রতিফলন দেখা যায় প্রবৃদ্ধির হারের ওপর। আবার বাজেট যেহেতু অর্থবছরের শেষে এসে পেশ করা হয়, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই বিদায়ী অর্থবছরের একটি খতিয়ানও প্রয়োজন হয়ে পড়ে।প্রবৃদ্ধির হার এককথায় সেই খতিয়ানকে তুলে আনে। সে জন্যই এ হার নিয়ে হইচই হয়, বিতর্ক হয়, মতবিরোধ হয়। সরকারের চেষ্টা থাকে অর্জিত হারের সপক্ষে যুক্তি দেখানো। বিরোধী দল ও সমালোচকদের চেষ্টা থাকে, এটা কতখানি ব্যর্থতা, তা পরিমাপ করা।
২০১২-১৩ অর্থবছরটি বর্তমান সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ অর্থবছর। আর তাই এই বছরের অর্জন খুব গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। ইতিমধ্যে এই অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হারের বিভিন্ন প্রক্ষেপণ বা পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, এবার প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ১০ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৪০ শতাংশের মধ্যে থাকবে। গড়ে এই হার দাঁড়ায় ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রবৃদ্ধির হিসাব চূড়ান্ত করে। এখন পর্যন্ত সংস্থাটির হাতে যে তথ্য-উপাত্ত আছে, তার ভিত্তিতে বিবিএস আভাস দিয়েছে যে প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ২০ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করবে। কিছুটা বেশি হওয়ার সম্ভাবনাও আছে।তবে তা জোর দিয়ে এখনো বলা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মনে করছে, এবার আর প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপরে যাবে না; বরং নিচেই থাকার সম্ভাবনা বেশি। আর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পূর্বাভাস দিয়েছে যে এ হার হবে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ।
বস্তুত রাজনৈতিক সংঘাত-অস্থিতিশীলতা, সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি পরিচালনায় দুর্বলতা আর অব্যবস্থাপনার সমন্বিত নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে অর্থনীতির গতিময়তার ওপর। তাই প্রবৃদ্ধির হার শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ বছরের প্রবৃদ্ধির হারের লেখচিত্র দেখলে তাই মনে হয়, এই সরকারের সময় যেখান থেকে শুরু করেছিল, সেখানে না হলেও কাছাকাছি একটা অবস্থানেই বুঝি বা ফিরে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়ায় ২০০৮-০৯ অর্থবছরের অর্ধেকটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের। তবে শেষ ছয় মাসে অর্থনীতির গতিমুখ নির্ধারণ দুঃসাধ্য থাকায় ওই অর্থবছরের ৫ দশমিক ৭ শতাংশের প্রবৃদ্ধি হার অর্জিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর ভর করে। ২০০৯-১০ পূর্ণাঙ্গ প্রথম অর্থবছর এই সরকারের যখন প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ১০ শতাংশে উন্নীত হয়। পরের বছর (২০১০-১১) তা আরও বেড়ে হয় ৬ দশমিক ৭০ শতাংশে। তার পরের বছর (২০১১-১২) কমে আসে ৬ দশমিক ৩০ শতাংশে। আর এবার? প্রবৃদ্ধির হার গতবারের চেয়ে কম হওয়ার আশঙ্কাই যে বেশি!
(রুপশী বাংলা নিউজ) ১৩ এপ্রিল /২০১৩.