অনুভূতিটা তাঁর কাছে ছিল একটু অচেনা। বেঞ্চে বসে বারবার দাঁতে নখ কাটছিলেন, মুখে রাজ্যের বিষণ্নতা। বোঝাই যাচ্ছিল, মনের মধ্যে ঝড় বইছে। দলকে এভাবে খাবি খেতে দেখার অভিজ্ঞতাও তো লিওনেল মেসির জন্য বিরল। কিন্তু মাঠে নামার মতো শারীরিক সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বলেই তিনি অতিরিক্ত তালিকায়! বার্সেলোনা গোল খাওয়ার পর আর তর সইল না, জুতার ফিতা বাঁধতে শুরু করলেন।গোটা ন্যু ক্যাম্পে শব্দ প্রপাত ঘটিয়ে নামলেন ৬৩ মিনিটে এবং হঠাৎই জাদুমন্ত্রে বদলে গেল গোটা দল। গোল পাননি, কিন্তু বার্সেলোনার রক্ষাকবচ গোলটার মূল কারিগর তিনিই। বলতেই হচ্ছে, অর্ধেক ফিট মেসির জন্যই বার্সেলোনা এখন চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ চারে। তা-ও আবার ইতিহাসের প্রথম ক্লাব হিসেবে টানা ছয়বারের মতো।
বার্সেলোনাকে ভয়ই ধরিয়ে দিয়েছিল প্যারিস সেন্ট জার্মেই (পিএসজি)। নিজেদের মাঠে আগের লেগটা ২-২ গোলে ড্র করার পর ন্যু ক্যাম্পে অসাধারণ কিছুই করতে হতো ফ্রেঞ্চ ক্লাবটিকে। সেই পথে অনেক দূর গিয়েছিলও, ৫০ মিনিটে হাভিয়ের পাস্তোরের গোলে এগিয়ে গিয়েছিল পিএসজিই। এর পরই মেসি নামলেন, আর পেদ্রো সমতা ফেরালেন বার্সার হয়ে। শেষমেশ ১-১ গোলে ড্র করার পর দুই লেগ মিলে স্কোর দাঁড়াল ৩-৩। পিএসজির মাঠে দুই গোল করার সুবাদে বার্সেলোনার ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়ল।
‘মেসি কি নামছেন?’—ম্যাচের আগে আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত প্রশ্ন ছিল এটাই। আগের লেগেই হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন। লা লিগায় মায়োর্কার সঙ্গে ম্যাচটায় তাই নামেননি। পুরো ফিট ছিলেন না বলে তাঁকে ছাড়াই প্রথম একাদশ সাজাতে বাধ্য হন কোচ টিটো ভিলানোভা। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতি ভীষণভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছিল শুরু থেকেই। মেসির জায়গায় নেমে ফ্যাব্রিগাস শুরু থেকেই ছিলেন ম্রিয়মাণ। সব সময়ের নির্ভরযোগ্য বুসকেটসও মাঝমাঠে বলের দখল হারাচ্ছিলেন।চোট-জর্জর রক্ষণটাও ছিল নড়বড়ে। আগের শনিবার মেসিবিহীন এই দলটাই না মায়োর্কাকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে? বিস্মিত ন্যু ক্যাম্পের এক লাখ দর্শক, তাঁরা বসে ছিলেন নিঃশ্বাস চেপে!
উল্টো দিকে পিএসজি শুরু থেকেই পাল্টা আক্রমণে ছিল দারুণ ক্ষুরধার। ভালদেজ বাধা হয়ে না দাঁড়ালে এগিয়ে যেতে পারত প্রথমার্ধেই। তাদের কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটা এল বিরতির পাঁচ মিনিট পর। পাল্টা আক্রমণ থেকেই। ইব্রাহিমোভিচের দুর্দান্ত থ্রু বলে বাঁ পায়ে লক্ষ্যভেদ করলেন আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার পাস্তোরে। ন্যু ক্যাম্প তখন নিথর। এরপর মেসি নামলেন ৬২ মিনিটে। বোঝাই যাচ্ছিল, পুরো ফিট নন। কিন্তু তাতে কী, ছন্নছাড়া বার্সা জিয়নকাঠির ছোঁয়া পেল তাতেই! নিচে থেকে বল ধরে দিলেন একটা দৌড়, নিখুঁত পাস দিলেন ভিয়াকে।ভিয়া সেটা পেছনে ঠেললেন পেদ্রোকে। তৈরিই ছিলেন পেদ্রো। বাঁ পায়ের গোলার মতো শট পিএসজি পোস্টের ডান কোনা দিয়ে ঢুকল জালে। মজার ব্যাপার, মেসি নামার আগে একটাও গোলমুখী শট নিতে পারেনি বার্সা!
বড় খেলোয়াড়েরা দলকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করেন, সেটাই দেখালেন মেসি। ফল-টল বাদ দিয়ে মেসি-বন্দনায় যে সবাই মাতবে, সেটা আর বিচিত্র কী! জেরার্ড পিকে যেমন বলে দিলেন আসল কথাটাই, ‘আমরা বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় নিয়ে কথা বলছি। সে একটু চোটগ্রস্ত থাকলেও সবকিছু বদলে দিতে পারে। ওর উপস্থিতিই আমাদের জন্য অনেক।’
সহকারী কোচ জর্ডি রৌরার কণ্ঠেও একই সুর, ‘ব্যাপারটা এমন ছিল, যদি সবকিছু ঠিকঠাক না যায়, তাকে (মেসিকে) আমরা নামিয়ে দেব। সে আবার দেখাল দলের জন্য তার আত্মনিবেদন কতটুকু। ওর জন্য আমাদের টুপি খুলতেই হচ্ছে।’
ম্যাচটা জিততে না পারলেও পিএসজি মাঠ ছেড়েছে মাথা উঁচু করেই। কোচ কার্লো আনচেলত্তি দলকে নিয়ে গর্ব করতেই পারেন, ‘জয়ের জন্য যা দরকার ছিল, তার সবই আমরা করেছি। আমরা দারুণ খেলেছি। খুব কাছাকাছিও চলে গিয়েছিলাম।’ এএফপি, ওয়েবসাইট।
( ১২ এপ্রিল/২০১৩) নিউজরুম।