মা—আনিসুল হক
প্রকাশক: সময় প্রকাশন
‘আজাদ ভাইয়ের মাকে নিয়ে একটা নাটক লিখে দাও। একুশে টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের নাটক করব।’
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বললেন আমাকে। আজাদের মায়ের গল্পটা তাঁর মুখ থেকেই প্রথম শোনা, ‘শোনো। আজাদ ভাইয়ের মা ভাত খেতেন না জানো। খুব কষ্ট করেছেন ভদ্রমহিলা। আজাদ ভাই তাঁর একমাত্র সন্তান ছিলেন। একাত্তর সালে আজাদ ভাই ধরা পড়লেন। মা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন রমনা থানায়। আজাদ ভাই বলেছিলেন, আমার জন্য ভাত এনো। মা ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখলেন, ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। আর এই মা ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এই ১৪টা বছর তিনি কোনো দিনও ভাত খাননি।’
গল্প শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। আমি বলি, ‘এই গল্প নিয়ে টেলিভিশনের নাটক নয়, আমি একটা উপন্যাস লিখতে চাই। আমাকে বিস্তারিত বলেন।’
নাসির উদ্দীন ইউসুফ, নাট্যজন ও মুক্তিযোদ্ধা, শূন্যের মধ্যে কী যেন খুঁজছেন, দূরাগত কণ্ঠে বলেন, ‘শোনো, আমি তো আজাদ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলাম না, ঘনিষ্ঠ ছিলেন হাবিবুল আলম বীর প্রতীক। একটা কাজ করি। আমি তোমাকে হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে বসিয়ে দিই।’
২০০২ সাল। একদিন নাসির উদ্দীন ইউসুফ ভাইয়ের পল্টনের বাসায় সন্ধ্যার সময় আমরা বসি। হাবিব ভাই তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার গল্প বিশদভাবে বলেন। শিমূল ইউসুফ শোনান সেই ভোরের গল্প, যেদিন বালিকা তিনি, গলা সাধছিলেন হারমোনিয়ামে, আর পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘিরে ফেলে তাঁদের বাসা, আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারীর সুরকার আলতাফ মাহমুদের কপালে বেয়নেট চালায় পাকিস্তানিরা, তাঁর কপালের চামড়া ঝুলে পড়ে চোখের ওপরে, তিনি কোদাল চালিয়ে বের করে দিতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা অস্ত্র।
ওই একই রাতে ধরা পড়েছিলেন আজাদ।তাঁদের বাড়ি থেকে মিলিটারি ধরে নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা ক্রিকেটার জুয়েলসহ অনেককে, আর পাকিস্তানি কর্তার অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি করতে করতে জন্মদিনের পোশাকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কাজী কামাল (বীর বিক্রম, এখন প্রয়াত)।
সারা রাত গল্প চলে। ভোরবেলা নাসির উদ্দীনদের বাড়ি থেকে বের হই।
আস্তে আস্তে আজাদের গল্পটা স্পষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আজাদের মায়ের বিশদ বিবরণটা কই পাওয়া যাবে? মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে। আমি একটা গল্পের ঘোরের মধ্যে নিশিপাওয়া মানুষের মতো তড়পাচ্ছি। অনন্যোপায় হয়ে বিজ্ঞাপন দিই প্রথম আলোয়। একাত্তর সালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদ, যিনি ধরা পড়েছিলেন জুয়েল, বদি প্রমুখের সঙ্গে, তাঁর কোনো খোঁজ কি কেউ দিতে পারেন। নিচে আমার নাম, আর মোবাইল নম্বর।
পরের দিন পত্রিকা প্রকাশিত হলে প্রথম আসে উড়ো কল।গালিগালাজ হজম করি। দ্বিতীয় ফোনটি করেন আজাদের দ্বিতীয় মা। যাঁকে আজাদের বাবা বিয়ে করেছিলেন বলে প্রতিবাদে আজাদের মা স্বামীর প্রাসাদোপম বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন সন্তানের হাত ধরে। আশ্রয় নিয়েছিলেন এক ছোট্ট ভাড়া বাসায়।
মগবাজারে এখন যেখানে কুইনস গার্ডেন সিটি নামে অ্যাপার্টমেন্ট উঠেছে, সেখানে ছিল আজাদের বাবার বাড়ি। তারই পেছনে একটা দোতলা বাসায় থাকতেন আজাদের দ্বিতীয় মা। তিনি আমার সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করেন।আজাদের ছোটবেলার গল্প শোনান বিস্তারিত। তিনিই বলেন, কীভাবে গাড়ি চালিয়ে তিনি আজাদকে নিয়ে গিয়েছিলেন গুলিস্তানে, কিনে দিয়েছিলেন এলভিস প্রিসলির গানের রেকর্ড।
দ্বিতীয় ফোনটি করেন গাজী আমিন আহমেদ, বামপন্থী রাজনীতিক, আজাদের দূর-সম্পর্কের ভাই, আমি ছুটে যাই তাঁর বাড়িতে। সেখান থেকে আমি সন্ধান পাই আজাদের নিত্যসহচর ও খালাতো ভাই জায়েদের। জায়েদ ভাইকে পাওয়া মানে সোনার খনি পেয়ে যাওয়া। আজাদের বাড়ির খবর, হাঁড়ির খবর, চিঠিপত্র, ফটোগ্রাফ—সব হাতে এসে যায়।
একজনের পর একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান পাই আমি। কাজী কামাল উদ্দিন থেকে শুরু করে শহিদুল্লাহ খান বাদল—আমি ছুটে যাই সবার কাছে।
তখন ৫১বর্তী ধারাবাহিক নাটকটার শুটিং হচ্ছে ডিওএইচএস মহাখালীর একটা বাড়িতে।রোজ সেখানে যাই শুটিং দেখার নাম করে, আর সেখানে না থেকে দুই বাড়ি পরে সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরীর বাসভবনে ঢুকে পড়ি। দিনের পর দিন শাহাদত চৌধুরী আমাকে বলেন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর গল্প। কফি খেতে খেতে শাহাদত ভাই একবার কাঁদেন, একবার হাসেন।
আমি আজাদের খালাতো ভাইবোন সবার সঙ্গে কথা বলতে তাঁদের বাড়ি বাড়ি যাই। টগর কিংবা মহুয়া—সবার কাছে আমি গেছি। একদিকে আমি সাক্ষাৎকার নিচ্ছি, বাড়িঘরগুলো দেখতে যাচ্ছি, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের বইপত্র, ইতিহাস পড়ছি। হাবিবুল আলম ভাই তাঁর ব্রেভ অব হার্ট বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিয়ে দিলেন, জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র—দিন নাই রাত নাই আমি পড়ে চলেছি। তথ্য মোটামুটি যা পেয়েছি, হয়ে যাবে। এবার দরকার লেখাটাকে সাহিত্য করে তোলার প্রস্তুতি।গোর্কির মা, ব্রেশটের জননী সাহসিকা, মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা—মা নিয়ে কে কোথায় কী লিখেছেন, জোগাড় করে এনে আবারও পড়তে লাগলাম। আমার মতো স্বার্থপর পাঠক জগতে দ্বিতীয়টা নাই, আপনি একটা বই দিয়ে পড়তে বললেই আমি পড়ব না, আলস্যবশতই; কিন্তু যে বই আমার দরকার, সেটা পড়ে ফেলতে আমার পঞ্চ-ইন্দ্রিয় এতটুকুনও শ্রান্ত হবে না।
তারপর এক সকালে লিখতে শুরু করলাম।
তিন পৃষ্ঠা লেখা হলো। পছন্দ হলো না। স্রেফ ওই ফাইল বন্ধ করে আরেকটা ফাইল খুললাম।
আবার প্রথম থেকে লেখা শুরু হলো। মায়ের সেই প্রথম তিন পৃষ্ঠার পরিত্যক্ত পাণ্ডুলিপি আমার কম্পিউটারে এখনো আছে।
মা উপন্যাসের সংক্ষেপিত সংস্করণ প্রথম বেরোল প্রথম আলোর প্রথম ঈদসংখ্যায় ২০০২ সালে। বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে হইচই। আমাকে চিঠি লিখেছেন লেখকদের মধ্যে জিয়া হায়দার আর রফিকুর রশীদ, পাঠকদের কত চিঠি যে পেলাম। বই হয়ে বেরোল ২০০৩ সালে। এর মধ্যে আরও কয়েকজনের কাছ থেকে আরও নতুন তথ্য পেয়ে বইটাকে বড় করতে হলো ২০০৩ সালেই।
আমার কাছে আজাদের চিঠিপত্র, ফটোগ্রাফ ইত্যাদি যা ছিল, তা আমি তুলে দেব মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের হাতে। তাই একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনেই। আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ ছিলেন, জায়েদ ভাই ছিলেন, আরও বেশ কজন ঢাকার গেরিলা উপস্থিত ছিলেন সেদিন।
আজাদের মায়ের প্রিয় গান ছিল—আজি বাংলাদেশের হূদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।
শিমূল ইউসুফ আমার অনুরোধে সেই গানটা গাইতে শুরু করলেন।
আমি দর্শকসারিতে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। আমার কান্না কেউ থামাতে পারে না।
গত দেড়টা বছর আমি ভীষণ একটা আবেগকে আমার বুকের মধ্যে পাথরচাপা দিয়ে রেখেছিলাম। আজ শিমূল ইউসুফের গান আমার বুকের পাথরটাকে সরিয়ে দিল।
মা বইটি লিখে আমি কী পেয়েছি? একটা ছোট ঘটনা বলি। আজাদের খালাতো ভাই জায়েদ একদিন আমাকে বললেন, আপনার জন্ম কবে?
আমি বললাম, কেন?
তিনি বললেন, আপনি বইয়ে এমন কিছু ঘটনা লিখেছেন, যা আমি আপনাকে বলিনি। কিন্তু আপনি সেটা নির্ভুলভাবে লিখেছেন। যেমন আজাদ দাদা করাচি যাওয়ার আগে আমাকে হাতঘড়ি দিয়ে গিয়েছিল, এটা তো আমি আপনাকে বলিনি। আপনি কোথায় পেলেন।
আমি বললাম, এটা আমি পেয়েছি রবিঠাকুরের ছুটি গল্পে। ফটিক কলকাতায় যাওয়ার সময় মাখনলালকে তার ঘুড়ি নাটাই সব দিয়ে যায়।
জায়েদ বললেন, ‘না না, হতেই পারে না। আজাদ দাদারও কান বড় ছিল। আপনারও কান বড়। আপনার জন্ম কবে?’
আমি বললাম, ‘আমার জন্ম ১৯৬৫ সালে, আর আজাদ শহীদ হয়েছেন ১৯৭১ সালে। পাগলামো কইরেন না।’
আমি জায়েদ ভাইয়ের মনে এই ধন্দ যে তৈরি করতে পেরেছি একটা বই লিখে, একজন লেখক হিসেবে এর চেয়ে বেশি আমি কী চাইতে পারি। তবু বলি, এ দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বুকের রক্ত দিয়ে আর বীর মায়েরা অশ্রু দিয়ে মায়ের কাহিনি রচনা করেছেন। ব্যর্থতার দায় লেখকের, গৌরবের ভাগ নয়!
২৬ মার্চ/২০১৩/নিউজরুম.