ব্যাটিংয়ে যেমন চনমনে লাগে, ব্যক্তি নাসির হোসেনও একই রকম। কথাবার্তায়, আচরণে এখনো কিশোরসুলভ একটা চপলতা। দুষ্টুমি করারও ওস্তাদ। তবে কাল দুপুরে গ্র্যান্ড উদাওলাওয়ে সাফারি রিসোর্ট হোটেলে বুফে থেকে প্লেটে খাবার তুলে নিতে নিতে যা বললেন, সেটিকে দুষ্টুমি মনে হলো না। ‘মনে হচ্ছে একটা কালো মুরগি সদকা দিতে হবে।’
বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে এখনো তুকতাকে বিশ্বাস আছে। চোর ধরতে বাটি চালান দেওয়া হয়। বুড়ো আঙুলের নখে চোরের চেহারা ভেসে উঠবে বলে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মানুষ। চালপড়া-টড়া তো আছেই। এসব কুসংস্কারের মিছিলে কালো মুরগির প্রাণহরণও দুঃসময় থেকে মুক্তির একটা উপায় হিসেবে বিবেচিত।
নাসির হোসেন হয়তো দুষ্টুমিই করেছেন। তবে সেই দুষ্টুমিতে ভুতুড়ে এ সফরটায় বাংলাদেশ দলের মানসিক অবস্থার একটা প্রতিফলনও থাকল। এনামুল-নাঈম-শাহরিয়ার নাফীস ছিটকে পড়েছেন সফর শুরুর আগেই। এখানে আসার পরও টুকটাক এটা-ওটা লেগেই ছিল। গলে প্রথম টেস্টের আগে দলের সঙ্গে আসা নির্বাচক হাবিবুল বাশার এক দিন বলছিলেন, ‘একটা ভয় ঢুকে গেছে মনে। ফিজিওর সঙ্গে দেখা হলেই প্রথমে জিজ্ঞেস করি, “এনি ব্যাড নিউজ?’”
গল টেস্টের আগে হঠাৎই রুবেলের পিঠে ব্যথা। শেষ পর্যন্ত আর খেলতেই পারলেন না। তামিম ইকবালও হেরে গেলেন চোটের সঙ্গে লড়াইয়ে। ওয়ানডে সিরিজে খেলতে এসেছিলেন নাজমুল হোসেন। শ্রীলঙ্কায় ঝটিকা একটা সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যেতে হলো সিরিজ শুরুর আগেই। অনেক নাটকের পর নাজমুলের বদলি হিসেবে শাহাদাত কাল বিকেলে হাম্বানটোটায় এসে যখন পৌঁছলেন, তামিম ইকবাল তখন কলম্বোতে। কাল সকালেই চলে গেছেন সেখানে। আজ ঢাকার বিমান ধরবেন।
নির্বাচকদের বেতন এই সিরিজে পুরোপুরি উশুল। আজ এর বদলি খুঁজতে হচ্ছে তো কাল ওর। সিরিজ শুরুর আগেই অবশ্য পূর্বাভাস ছিল। দল ঘোষণার পর কলম্বোর বিমানে উঠতে উঠতেই দলে তিনটি পরিবর্তন। ক্রিকেট ইতিহাসেই রেকর্ড কি না, খুঁজে দেখার মতো ঘটনা।
তামিম ইকবালের বদলি হিসেবে আসছেন শামসুর রহমান। হাম্বানটোটার পর্ব তো শেষ হয়ে যাচ্ছে আজই। এখানে না এসে সরাসরি ক্যান্ডি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।সেটি না হলে আজ হাম্বানটোটাতেই এসে আগামীকাল হাম্বানটোটা টু ক্যান্ডি হেলিকপ্টার-যাত্রায় বাংলাদেশ দলের সঙ্গী হবেন। প্রথম ওয়ানডেতে আঙুল ভেঙে তামিমের আকস্মিক বিদায় বাংলাদেশ দলের মনে একটা ভয়ই ধরিয়ে দিয়েছে, ক্যান্ডিগামী হেলিকপ্টারের বদলে আবার না কাউকে কলম্বোতে ঢাকার বিমান ধরতে যেতে হয়!
হাবিবুল বাশার কাল দুপুরে একটু হকচকিত ভঙ্গিতেই বলছিলেন, ‘সবকিছু ভুতুড়ে লাগছে। বাংলাদেশের আর কোনো সিরিজে এমন হয়েছে বলে মনে পড়ে না।’ দলের সফরসঙ্গী বোর্ড কর্মকর্তা গাজী আশরাফ হোসেনের মনে পড়ে যাচ্ছে ১৬ বছর আগে এই শ্রীলঙ্কাতেই এশিয়া কাপের কথা। এক ম্যাচে এর চোট-ওর জ্বর মিলিয়ে পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে কোচ গর্ডন গ্রিনিজ ম্যাচের দিন সকালে সাদা পোশাক-টোশাক পরে রেডি! প্রয়োজনে ফিল্ডিং করবেন বলে ম্যাচ রেফারির সঙ্গে নাকি কথাও বলে এসেছিলেন!
কাঁধে অস্ত্রোপচারের ধাক্কা সামলে রুবেল হোসেন মাঠে ফিরেছেন খুব বেশি দিন হয়নি। কাল টিম হোটেলে লাঞ্চ করতে করতে বলছিলেন, ‘আল্লাহর কাছে হাজার শোকর যে আবার মাঠে ফিরতে পেরেছি। বাংলাদেশে এর আগে নাকি কেউ কাঁধে অপারেশন করানোর পর ফিরতে পারেনি।’ কাঁধে এখন আর কোনো সমস্যা নেই। তবে এই সফরের দল ঘোষণার পর থেকেই ভুতুড়ে যেসব ঘটনা ঘটছে, নতুন কোনো সমস্যা হতে কতক্ষণ! পেস বোলাররা একের পর এক ইনজুরিতে পড়ছে দেখে একটু ভয়ও হয়তো কাজ করছে তাঁর মনে, ‘কী যে হলো! পেসারদের সবার ইনজুরি। মাশরাফি ভাই, সুহাস (শফিউল), নাজমুল ভাইও এসে চলে গেলেন। তাসকিনেরও হাঁটুতে সমস্যা।’
ওয়ানডে সিরিজে খেলুন না-খেলুন, দলের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতাটা তাসকিন আহমেদকে উপহার দেওয়ার একটা চিন্তা নাকি ছিল নির্বাচকদের। এই সফরের জন্য নির্বাচকদের চিন্তায় যতজন ছিলেন, তাঁদের মধ্যে তাসকিনই তাহলে শুধু বাদ থাকলেন। সম্ভাব্য বাকি সবাইকেই বোধ হয় শ্রীলঙ্কায় খেলানো হয়ে গেল!
নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা দুঃসময়ে ‘ভালো দিক’ খুঁজতে হয়। হাবিবুল বাশার সেটি খুঁজে পাচ্ছেন সিরিজটা শ্রীলঙ্কায় বলে, ‘কপাল ভালো, শ্রীলঙ্কায় খেলা হচ্ছে আর ঢাকা থেকে মিহিন লঙ্কার সরাসরি ফ্লাইট আছে। একবার ভাবুন, জিম্বাবুয়েতে এমন হলে কী অবস্থা হতো!’
জিম্বাবুয়ে সফর তো আগামী মাসেই। তখন এমন না হলেই হয়! একটা কালো মুরগি সদকা দিয়ে ফেলাই ভালো, কী বলেন!
(২৫ মার্চ/২০১৩) নিউজরুম।