বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা একটা অতি স্বাভাবিক বিষয়।একসময় আমাদের দেশে সুবোধ ছাত্রদের জন্য রাজনীতিতে জড়ানো ছিল একটা অতি গর্হিত ব্যাপার। অথচ ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনে জড়িতদের প্রায় সবাই ছিলেন মেধাবী এবং নিবেদিতপ্রাণ। ছাত্রদের এই আন্দোলনের সফলতার হাত ধরেই আসে আমাদের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা। রাজনীতি অর্থ রাষ্ট্রশাসন কিংবা রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি, যদিও শব্দটির ইংরেজি ভাষ্য ‘পলিটিকস’ উদ্ভূত হয়েছিল গ্রিক শব্দ ‘পলিটিকা’ থেকে, যার অর্থ নগর অথবা নাগরিকসংক্রান্ত, আজকাল শব্দটি রাষ্ট্রপরিচালনার নীতির সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে। ফলে রাষ্ট্রপরিচালনায় অদক্ষতা কিংবা ব্যর্থতা থেকে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদকেই বলা যায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল তৎপরতা। যেসব দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো সম্ভব হয় না, সেসব অপূরণীয় চাহিদার কারণ দেশের সহজাত দারিদ্র্য হলেও তার দায়ভার সরকারের ওপরই বর্তায়। সে জন্য রাজনৈতিক গোলযোগ, সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ও আন্দোলন ইত্যাদি একটা দরিদ্র দেশের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত একটা দেশের সরকার কখনোই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে না। একটা বিষয় বিস্মৃত হওয়া উচিত হবে না যে সাধারণ মানুষ কেবল তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই সরকার পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেয় না, তাদের কল্পনায় সুশাসনের যে চিত্র থাকে, সেই সুশাসন কামনা করেই তারা সরকার নির্বাচিত করে। এই সুশাসন কারও কাছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার দক্ষতা, কারও কাছে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, আবার কারও কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত রাখার সামর্থ্যকে বোঝায়। বলাবাহুল্য, সীমিত সম্পদসহ জনসংখ্যাবহুল ও নিম্ন আয়ের একটা দেশে গণমানুষের এসব চাহিদা মেটানো কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব হয় না।
তবে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম, কোনো নির্দিষ্ট দাবি আদায়ের জন্য অন্দোলন বা ধর্মঘটের প্রক্রিয়া পৃথিবীর ধনী-দরিদ্র সব দেশেই বিদ্যমান। সেখানে এয়ার ফ্রান্সের কর্মচারীদের আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের নৌপরিবহন বা পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটের কোনো গুণগত বা প্রক্রিয়াগত পার্থক্য নেই। আবার বৃহত্তর রাজনৈতিক দাবি আদায়ের জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের মধ্যেও কোনো চরিত্রগত তফাত থাকে না, এমনকি সেসবের প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতিও এক ও অভিন্ন হতে দেখা যায়। সেসব সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় দেশ ও জাতির সম্পদের সমূহ ক্ষতি সাধিত হয়।যেমন আমাদের দেশটির জন্মই হয়েছিল এক প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গোলযোগের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই টালমাটাল দিনগুলো অস্থিরতাপূর্ণ হলেও তার মধ্যে ছিল বৃহত্তর স্বার্থের বীজ। বস্তুত বায়ান্ন-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল বরং আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির পথনির্দেশ। পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং বৈষম্যের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বেগবান হয়েছিল বলেই আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে লাভ করতে পেরেছিলাম একটা স্বাধীন রাষ্ট্র এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। লক্ষণীয় বায়ান্ন-পরবর্তী রাজনৈতিক স্বাধিকারের জন্য যে আন্দোলন, তার কারণে এই প্রদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেই রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কেউ উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অন্তরায় হিসেবে গণ্য করেনি, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক তৎপরতার একটা বড় সুবিধাভোগী ছিল পশ্চিম পাকিস্তান।আমরা জানি, ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার মূল দাবিটি আবর্তিত হয় মূলত অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার বিষয়টি ঘিরে। যেহেতু আমাদের উৎপাদিত সম্পদ ব্যবহার করে পুষ্ট হতো পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি, তাই সেই আন্দোলন এবং ক্রমাগত রাজনৈতিক গোলযোগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করলেও সেটিকে কেউ ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম বলে চিহ্নিত করেনি। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহু পর্যবেক্ষকের সন্দেহ ছিল বাংলাদেশ একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে কি না। উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, সুশাসনের অভাব ইত্যাদি কারণে এমনকি একসময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে গণ্য করা হতো পাশ্চাত্য বিশ্বে। সেসব অপপ্রচার এবং ভুল ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের যে ক্রান্তিরেখায় পৌঁছেছে, তাতে বিশ্বব্যাংকসহ অনেক আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী মনে করে, ২০১৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশ একটা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে সহজেই। তবে তার জন্য দরকার হবে প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে সাত শতাংশে উন্নীত করা। প্রবৃদ্ধির এই হার অর্জন করতে হলে বাড়াতে হবে উৎপাদন সক্ষমতা ও দক্ষতা, দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। লক্ষণীয় যে কয়েক বছর ধরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। এমনকি বিশ্বমন্দায় আক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ কিংবা আরব বসন্তের কবলে পড়া মধ্যপ্রাচ্যের আন্দোলিত অর্থনীতির প্রভাবও আমাদের প্রবৃদ্ধির ধারাকে স্তিমিত করতে পারেনি।
কিন্তু জাতীয় অর্থনীতির এই নিরুদ্বেগ অবস্থা আজ আর অব্যাহত নেই। চলতি বছরের শুরু থেকেই যে রাজনৈতিক দুর্যোগের অশনিসংকেত দেখা যাচ্ছিল, সেটির বিস্ফোরণ প্রায় অবশ্যম্ভাবী। একাত্তর-পরবর্তী সময়ে দেশের আর কোনো রাজনৈতিক গোলযোগে এত মানুষ প্রাণ হারায়নি, ধ্বংস হয়নি এত সম্পদ, নষ্ট হয়নি এ পরিমাণ অবকাঠামো।এই অস্থিরতা এবং ধ্বংসলীলার বাড়তি চাপ অর্থনীতি কতখানি সহ্য করতে পারবে, সেটা এখনো অনুমিত নয়। আমাদের মতো দেশে রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি অতি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও রাজনৈতিক প্রতিবাদের নামে এ রকম পরিকল্পিত তাণ্ডব জাতি আগে কখনোই প্রত্যক্ষ করেনি। নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয়ে দেশের নাগরিকদের দ্বারা সংঘটিত জাতীয় সম্পদের এমন ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তাঁদের দেশপ্রেম প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। দেশপ্রেম যদি ঈমানের অঙ্গ হয়, তাহলে এসব কার্যকলাপকে কী বলা যায়?
আমাদের স্মরণে রাখা উচিত যে আমাদের অর্থনীতির পুষ্টি আসে বিদেশি আয় থেকে, যার একটা বড় অংশ জোগান দেয় আমাদের রপ্তানি খাত। সেই খাতটির যারা প্রতিপক্ষ, তারা যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক গোলযোগ দেখলে আমাদের দেশের সঙ্গে ব্যবসা গুটিয়ে নেবে নির্দ্বিধায়।আমাদের এই আশঙ্কার যথার্থতা প্রমাণ করে ইতিমধ্যে কিছু বিদেশি ক্রেতা ঢাকার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের পরিবর্তে তারা বেছে নিতে পারে মিয়ানমার, ভিয়েতনাম কিংবা কম্বোডিয়াকে। বেশ কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং ক্রেতা বাংলাদেশের উপর্যুপরি হরতাল এবং অবিশ্বাস্য ধ্বংসলীলা দেখে তাঁদের ঢাকা সফর বাতিল করেছেন বলে জানা যায়। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে শিল্প স্থাপনে আগ্রহী একটি বড় ইলেকট্রনিক কোম্পানিও সম্প্রতি তাদের ঢাকা সফর বাতিল করেছে হরতালের কারণে।
এমনিতেই আমাদের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প, বহুবিধ অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং অন্যান্য বিষয়ে বিশ্বের বড় এবং খ্যাতনামা ক্রেতা-প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের ভাগ্যবিধাতার ভূমিকায় অধিষ্ঠিত। খবরে প্রকাশ, বিশ্বের বৃহত্তম রিটেইল প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট সম্প্রতি তাদের পোশাক সরবরাহকারীদের তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম কেটে দিতে উদ্যত, কারণ, আমাদের এই খাতটির শ্রমিকশোষণ এবং নাজুক নিরাপত্তাব্যবস্থা।এসব সমস্যার সমাধানের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি এমনকি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতেও প্রস্তুত। বিভিন্ন সময়ে অগ্নিকাণ্ড এবং অন্যান্য দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের প্রাণহানিকে বিদেশি ক্রেতারা কখনোই ভালো চোখে দেখেননি। দ্বিতীয়ত, প্রধানতম যে কারণের জন্য বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরের স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে, সেই স্বল্প মজুরির অবস্থানটি আর বাংলাদেশের একক দখলে নেই।আমাদের পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের গড় মজুরি ঘণ্টায় ১৮ থেকে ২৬ সেন্ট হলেও কম্বোডিয়ায় ২৯ সেন্ট আর ভিয়েতনামে ৫৫ সেন্ট। অতএব দেখা যাচ্ছে, সস্তা শ্রমের বাজার বাংলাদেশের আর একচেটিয়া থাকবে না। ইতিমধ্যে মিয়ানমার যদি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য যথার্থভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, সেখানকার শ্রমবাজার বাংলাদেশের স্থান দখল করে নিতে পারবে অবলীলায়।
উপরন্তু জ্বালানি সমস্যা, পর্যাপ্ত ভূমির অভাব—এসব কারণে আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ যেখানে বাধাগ্রস্ত, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা ক্ষীণতর।মূর্তিমান এই সমস্যার ওপর চেপে বসতে যাচ্ছে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ। অতীতের যেকোনো রাজনৈতিক সহিংসতার তুলনায় এবারের তাণ্ডবের বৈশিষ্ট্য ছিল পরিকল্পিত নাশকতা এবং সেসব পরিচালিত হয়েছে অবকাঠামোর বিরুদ্ধে, যেমন রেললাইন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সরকারি দপ্তর ইত্যাদি।বৃক্ষনিধনের এমন মহাযজ্ঞ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল সীমিত করতেও চালানো হয়নি। এসব কার্যকলাপ দেখে প্রতীয়মান হয়, এগুলো বাংলাদেশবিরোধী কোনো বিদেশি শক্তির মদদে পরিচালিত। কারণ, কোনো দেশপ্রেমিক মানুষ স্বদেশের এমন ক্ষতিসাধন করতে পারে না। ফলে জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনীহা, যার অর্থনৈতিক পরিণতি অদৃশ্য অথচ ভয়াবহ। অন্যান্য খাতের হিসাব না করেও কেবল দুই হাজার কোটি ডলারের তৈরি পোশাকশিল্প
খাত যে আজ হুমকির সম্মুখীন, সেটি আমাদের দেশপ্রেমিক (!) নেতাদের উপলব্ধি করতে আহ্বান জানাই। কারণ, তাঁদের শুভবুদ্ধির ওপরই নির্ভর করছে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ।
ফারুক মঈনউদ্দীন: ব্যাংকবিষয়ক বিশ্লেষক।
২৪ মার্চ/২০১৩/নিউজরুম.