ছবিটা সাধারণ। ছবিটা নেহাত সাদাকালো। ছবিটা একটি টেবিল ঘিরে কয়েকজন মানুষের বৈঠক করা নিয়ে। আপাত নিরীহ (!) এমন এক ছবির সামনে দাঁড়াতেই কিনা শরীরের ভেতর রি রি করে উঠল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শোভন রহমানের।চোয়াল শক্ত করে আড়চোখে তাকালেন তিনি সঙ্গে আসা বন্ধু অদিতের দিকে। এবং বিস্ময়! সত্যিই বিস্ময়! শোভন দেখলেন অদিতের চোখেমুখেও সেই একই যন্ত্রণার আধিপত্য।
এবার আপনি, সেই ছবির ক্যাপশন পড়ে দেখুন তো, শোভন ও অদিতের অনুভূতির সঙ্গে আপনার অনুভূতি মিলে যায় কি না—‘টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করছেন গোলাম আযম ও তাঁর দোসররা।’
ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রাখা আছে এই ছবি। এখানে আছে মুক্তিযুদ্ধের আরও অসংখ্য নিদর্শন। প্রতিদিন শত শত তরুণ-তরুণী ভিড় করেন এখানে। ‘কেননা এখানে এলে মুক্তিযুদ্ধকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করা যায়। এখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের জীয়নকাঠি।’ দাবি, এখানে ঘুরতে আসা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সারা তাসকিনের।
কথা মিথ্যে নয়। এখানে নীরব ভাষায় গল্প বলছে একাত্তর। মহৎ সেই গল্প শুনতে হলে শোভন-অদিত-সারার মতো আপনাকেও আসতে হবে এই জাদুঘরে। পা রাখতে হবে ভবনের সব কটি কক্ষে। যেমনটা এসেছেন মেহেদী, রিপন, ভূপেশ, লিপু, বৃষ্টি ও মিম। ছয় সদস্যের এই তরুণ দল এসেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
পাঁচ নম্বর কক্ষে এসে গতি শ্লথ হয় তাঁদের।‘দ্যাখ, দ্যাখ, এই রেডিও রিসিভারটা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ব্যবহূত হতো…এই হেলমেট, এই পানির মগ… এগুলো ব্যবহার করতেন মুক্তিযোদ্ধারা।’ টুকরো টুকরো কথা আর মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন দেখা চলে একসঙ্গে।মুক্তিযোদ্ধাদের পোশাক, মেশিনগানের গুলির চেন, শরণার্থী শিবিরের করুণ ছবি, ভারতের কোন রাজ্যে কতজন বাঙালি আশ্রয় নিয়েছিল তার পরিসংখ্যান, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে খণ্ড-বিখণ্ড বৌদ্ধমূর্তি, স্বাধীন বাংলার পতাকা, মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা চিঠি, ডায়েরি, সেই সময়ের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকার কাটিং, ইন্দিরা গান্ধী ও এডওয়ার্ড কেনেডির শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের ছবি, পাকিস্তানি বাহিনীকে আহ্বান জানিয়ে লেখা যৌথ বাহিনীর লিফলেটের খণ্ডাংশ ইত্যাদি দেখতে দেখতে তাঁরা হঠাৎ আবিষ্কার করেন তাঁদের বন্ধু মেহেদী নিখোঁজ! কোথায় গেল, কোথায় গেল? তাঁকে পাওয়া গেল ছয় নম্বর কক্ষে। দুহাত বুকে ভাঁজ করা, বিমর্ষ মুখ, চোখে জল—মেহেদী ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন স্বচ্ছ কাচঘেরা এক বাক্সের সামনে। আর বাক্সটা ভর্তি মানুষের হাড়গোড় আর মাথার খুলিতে! বাক্সের গায়ে লেখা—‘মিরপুর মুসলিমবাজার ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা শহীদদের কঙ্কাল ও মাথার খুলি।’
বন্ধুর বিষণ্নতা মুহূর্তেই সংক্রমিত হয় অন্য বন্ধুদের মধ্যে। মুহূর্তেই সবার চোখের উপকূল ভিজে ওঠে জলে। সেই জলভরা চোখ নিয়েই বেরিয়ে আসেন সবাই। কারও মুখে কোনো কথা নেই। কথা বলার দরকারই বা কী! মুখের ভাষার চেয়ে চোখের জলের ভাষাই তো অনেক বেশি সহজ।
২৪ মার্চ/২০১৩/নিউজরুম.