পাঁচ নাম্বার ঘাট। একটু দেিণ লঞ্চ টার্মিনাল। তার পাশ ঘেঁষেই শহরের প্রধান বাস টার্মিনাল। বন্ধন আনন্দ উৎসব সেতু অবশ্য কাউন্টার সার্ভিস। তার পরও বাসগুলো এলোমেলো পার্কিং করায় স্বাভাবিক চলাচলে অনেক বিরক্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়। কারণ রাস্তা দখল করে বসে আছে এলোমেলোভাবে অনেক ফলের দোকানদার। তবুও এ শহরের যাত্রীরা আয়েশে আজকাল ঢাকা বা যার যার ঠিকানায় শান্তিমতো যেতে পারে। আগে তাও ছিল না। আগে ছিল লক্কড়ঝক্কড় করতোয়া আর কিছু মুড়ির টিন বাস। ওতে করে বাদুরের মতো জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঝুলে পড়া। ছোট্ট এই শহরের পথঘাট কোনোটারই রূপ-যৌবন বলতে কিছুই ছিল না। ছিল না কোনো পার্ক বা শিশুদের নিয়ে একটু বেড়ানোর জায়গা। এখন হয়েছে অনেক কিছুই, এখন জনগণের কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে সাবেক পৌর চেয়ারম্যানের সুযোগ্য কন্যা আসন অলঙ্কৃত করেছেন। এখন এ শহরের শরীরে আলাদা প্রসাধনী। কোনো শত্র“ও বলতে পারবে না এখানে কাজ হচ্ছে না।
শহরের রাস্তাঘাটের লাবণ্য বেড়েছে।সৌন্দর্য বাড়ার সাথে সাথে পথঘাট অনেক প্রশস্ত হয়েছে। ডিভাইডারগুলো ফুলে আর বৃে তার সবুজ বাহারি শরীরকে জানান দিচ্ছে। তবে এসব শেষ করতে গিয়ে পৌরসভার কর্মীদের কম কষ্ট করতে হয়নি; কারণ যখন কোনো অলিগলিতে রাস্তা প্রশস্তের জন্য গাড়ি ঢুকেছে তখনই প্রভাবশালী কেউ বা মেয়রের আত্মীয়রা কর্মীদের ফেরত পাঠিয়েছেন এই বলে যেÑ গিয়ে বলো আমি মেয়রের অমুক, এখানে বাড়ি ভাঙা যাবে না। এসব শুনে মেয়র বিনয়ের সাথে আবার কর্মীদের রাস্তা ভাঙার জন্য পাঠিয়েছেন। কর্মীদের বলেছেনÑ শহর উন্নয়নের কাজে বাধা হলে মেয়রের আপন বোনকেও ছাড়া হবে না।
তো এই হলো নারীদের মডেল নতুন মেয়র। সাবেক চেয়ারম্যানকন্যা বর্তমান মেয়র আজ বাংলাদেশের নারী নেত্রীদের অন্যতম। কাছের, ঘরের, বাইরের জাতীয় পর্যায়ের অনেকেই তাকে সম্মান করেন, যা আজকাল অনেক জাতীয় পর্যায়ের নেতানেত্রীর কপালেও জোটে না।
আগে ছিল না এত পরিকল্পিত সৌন্দর্যের পূজা এই শহরে। যখন হাসান আলী মাস্টার এ পথে আসা-যাওয়া করত। তখন পাঁচ নাম্বার ঘাটের পানি থেকে শ্যাওলা আর সারা শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের আবর্জনার ময়লা গন্ধে অনেকেরই বমির ভাব হতো।
আর এখন এখানে বসে থেকে অনেকেই বলাবলি করে যে, মনে হয় একটা চমৎকার সি বিচের ধারে বসে আছি। সেই টার্মিনাল থেকে শুরু করে নদীর পাড় ঘেঁষে সুন্দর পরিকল্পিতভাবে পাকা ড্রেনেজ সিস্টেম করা হয়েছে আর পথচারীদের জন্য প্রশস্ত স্ল্যাবের মাধ্যমে ফুটপাথ করা হয়েছে, যা গিয়ে বাঁক নিয়ে চাড়ার গোপ হয়ে সেই কুমুদিনী গিয়ে ঠেকেছে। সব শরীরের পানি ডুবিয়ে নদী যখন তার যৌবনের ডাক দিয়ে যায় তখন মনে হয় সত্যিই প্রাকৃতিক নৈসর্গে ভরা এই বাঁকটুকু যেন সবার নজর কাড়ে; মনে হয় যেন এই শহরের মানুষের আর কক্সবাজারের স্বাদ একটু হলেও এখানে দাঁড়িয়ে মেটানো যায়। এটা অতিরিক্ত মনে হলেও সত্যিকারের উপলব্ধি মাধ্যমেই টের পাওয়া সম্ভব।
তার পরও একটির অভাব আজো সবাই অনুভব করে। তা হলো কালীরবাজার চাড়ার গোপের ফলপট্টি ঘেঁষে নদীর যে বাঁকটি যুবতীদের কোমরের মতো অপার সৌন্দর্য নিয়ে কুমুদিনী গেছে তা থেকে বিভিন্ন ট্রলার আর পণ্যবাহী নৌকা ভিড়তে না দিলে আরো মোহনীয় হয়ে উঠতে পারে আর যদি সেখানে পর্যটনের একটি ভাসমান রেস্তোরাঁ যোগ করে দেয়া যায় তাহলে এই শহরের মননশীল মানুষেরা সারা জীবন এখানকার সুখে অবগাহন করে যেতে পারবে। এমন ভাবনায় অবশ্য কেউ কেউ না পড়লেও হাসান আলী মাস্টারের একমাত্র ছেলে সাংবাদিক নাফিজ আশরাফ পড়ে। যখন সে একরামপুরের বাড়ি থেকে প্রতিদিন এ পথে নৌকা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় যায়, তখনই তার চোখে এমন একটি স্বপ্ন তাড়িত হয়।পরপরই অবশ্য ছোট বোনের একটি অস্বাভাবিক ঘটনায় নিজেকে স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে।
নাফিজ ছোটবেলায় বাবার সাথে প্রতিদিন এ পথে স্কুলে যেত আর ফেরার পথেও বাবার হাত ধরে এদিক দিয়ে আসত। এ পথ নাফিজের শরীরের ভেতর নাড়ির মতোই এক সাথে গাঁথা। বাবা আমলাপাড়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক, কত টাকাইবা বেতন। তবু সংসারে শান্তি ছিল। অল্প বেতনেই চলে যেত সংসার। নিজের বাড়ি থেকে প্রতিদিন আসা যাওয়া। খরচের মধ্যে কেবল নাফিজের আবদার রার জন্য টিফিনের সময় এটা ওটা কিনে দেয়া। আর ছিল একমাত্র মেয়ে সুমি যে একরামপুর প্রাইমারি স্কুলে পড়ে, তার জন্য আলাদা শিক রেখে পড়ানোর খরচ দেয়া। তবে হাসান আলী মাস্টার বুদ্ধি করে নিজের বাড়িতে চার রুমের একটি টিনের ঘর করে তাতে ভাড়া দেয়ায় ক’টা টাকা ওখান থেকেও আসে। তাই অভাব তাকে পাকড়াও করতে পারে না।
মৃত্যুর প্রায় ৩০ বছর আগে কুমিল্লার হোমনার গ্রামের বাড়ির বাটোয়ারা নিয়ে ছোট ভাইয়ের সাথে রাগ করে একপর্যায়ে নিজের অংশটুকু বেচে দিয়েই একরামপুরের এই ৮ শতাংশ মাটি কিনে বসবাস করা। এ সংসারে নাফিজের ছয় বছর পর যখন সুমি জন্ম নিলো তারও বছর দুয়েকের পরই হাসান মাস্টারের স্ত্রী চলে গেল ওখানে, যেখান থেকে আর কেউ ফেরত আসে না। অনেকের অনুরোধ থাকার পরও হাসান মাস্টার আর দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। লোকটি হয়তো কোনো অভিমান না হয় সত্যি নিজের স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসত বলেই সুমি আর নাফিজকে বুকে পিঠে করে জীবনটা পার করে গেল।
হাসান মাস্টার নিষ্ঠা আর সততার গুণে স্কুলের হেড স্যার পর্যন্ত তার নিজের চাচাতো শ্যালিকার সাথে সম্পর্ক করাতে চেয়েছিল। তাই এক দিন অফ কাসে নিজেই প্রস্তাব দিয়ে দেয়Ñ
Ñহাসান সাহেব, বয়স হইছে, নিজের সেবার জন্যও তো একটা দাসী-বান্দী ঘরে থাকে। মনে করেন বিয়া কইরাই একটা দাসী-বান্দী রাখলেন।
Ñনা স্যার, আমার দুইটা চোখের মণিরে আর কষ্ট দিতে চাই না। সৎ মায়ের জ্বালা আমি বুঝি। নাফিজ আর সুমি বড় হইলে আমার আর কোনো কষ্ট থাকব না।
Ñতবু চাইছিলাম আপনার সংসারের ঝামেলা একটু কমাই।
Ñআপনাদের দোয়ায় আমি অনেক শান্তিতে আছি, কোনো ঝামেলা নেই স্যার। আর ক’টা বছরই চাকরি আছে। তার পর তো আস্তে আস্তে চইলা যামু নাফিজের মায়ের কাছে।
হাসান মাস্টার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হেড স্যারের মুখের দিকে তাকায় আর নিজের মরণের জন্য একটা ছবি আঁকে মনের ভেতর। ওখানে সাদা কাপড় পরা লাশ হয়ে নিজেই শুয়ে পড়ে খাটে। মনে মনে ভাবে নাফিজের মা এই দৃশ্য দেখে খুব খুশি। ওই দূর কবরে শুয়েই কণ্ঠ নামিয়ে স্বামীকে বলেÑ
Ñখুউব ভালো একটা কাম করলেন আইসা। কত বছর হইল আপনে আসেন না, খালি ইস্কুল আর পোলাপান লইয়া পইড়া থাকেন।আপনে কত নিষ্ঠুর দেখেন, সারা জীবন আপনার সংসারের চুলা ঠেইলা আর পোলাপান দেইখা আসলাম অথচ আমারে একলা রাইখা আপনে দিন কাটাইতাছেন।
স্কুলের ঘণ্টার আওয়াজে নিজের মধ্যে ফিরে আসে হাসান মাস্টার। সে খেয়াল করে এখনো হেড স্যারের রুমেই বসে আছে কিন্তু হেড স্যার নেই। হয়তো কোনো রুটিন ডিউটিতে বের হয়েছে।
স্কুল ছুটির পর ধীরে ধীরে হাসান মাস্টার বাড়ির উদ্দেশে বের হয়। এখন আর ছেলে নাফিজ সাথে আসে না। নাফিজ গত বছরই সাংবাদিকতায় অনার্স করে একটা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জয়েন করেছে। নতুন চাকরি তাও মিডিয়ায়, সময়মতো বাড়ি ফেরার নাম নেই। হাসান মাস্টার ছেলের জন্য তবু অপো করে পাঁচ নাম্বার ঘাটে। ফেরার পথে হাতে করে প্রতিদিনের যে পেপার নিয়ে আসে তা নিয়ে ঘাটে হারু মিয়ার চায়ের দোকানে বসে পেপারের পাতা উল্টাতে উল্টাতে সব খবর পড়ে। ওখান থেকে কয়েকটা চুম্বক সংবাদ নিয়ে পাশে বসে থাকা দু-একজনের সাথে কথার খই ফোটায়।
হারু মিয়ার দোকানে বসে বসে দু-এক কাপ চা গলায় ঢালে হাসান মাস্টার। মাঝে মধ্যে অন্যরাও তাকে অফার করে, কাউকে ফিরিয়ে দেয় না। সবার সাথেই সখ্য তার। তা ছাড়া যারা বিকেলে এখানে এসে বসে, তাদের অনেকেই অফিস, ব্যবসা, স্কুল, কলেজ শেষ করেই আসে। হারু মিয়ার দোকানটি যেন একরত্তি জিরোবার জন্য ভালো পয়েন্ট বক্স। একরামপুর, সিএসডি, নবীগঞ্জ, ইস্পাহানি, চিতাশাল, নোয়াদ্দা, কাইতা খাল, বন্দরের অনেক বেপারি এ পথে তরিতরকারি বা বিভিন্ন পণ্যসহ টাটকা সবজির বোঝা নিয়ে নৌকায় পার হয়ে বেচার জন্য দিগুবাবুর বাজারের উদ্দেশে আসা-যাওয়া করে। প্রায় সবাই হাসান মাস্টারের ভক্ত। অনেকের ছেলে মেয়েইতো তার হাতে মানুষ। অন্তত স্কুলের পাঠ তো তার হাতে। তাই গার্জিয়ানদের সম্মান আর সালাম নেয়ার জন্য হাসান মাস্টারের ঠোঁট যেন তড়বড় করতে থাকে। তার ওপর নদী পারাপারের সময় ছেলেমেয়েরাও সামনে পড়ে তাকে সালামে সালামে ব্যস্ত রাখে।
কিন্তু এই সম্মানে নদীর স্রোতের মতোই একদিন ভাটা পড়ে।
এর দুটো কারণÑ প্রথমটি হলো যে দিন সবাই জানল হাসান মাস্টারের চাকরি শেষ, সে অবসরে গেছে, তার পর থেকেই সেসব প্রিয় লোকগুলোই যেন বদলে যেতে লাগল। কাছের লোকগুলোই ধীরে ধীরে হাসান মাস্টারকে সমীহ করা কমাতে লাগল। আগের মতো তাকে ডাকচাপ দিয়ে কথা বলে না। আবার এমনো হতে পারে যে, তার ছেলে নাফিজ মিডিয়া জগতে থাকায় অনেকেই ভেতরে ভেতরে ভয় পেতে থাকে আবার কখন কার কোন গোমর ফাঁস হয়ে যায়। তাই অনেকেই হাসান মাস্টারের কাছ থেকে অনেটা দূরত্ব তৈরি করে মেলামেশা করে।
দ্বিতীয় যে কারণ সেটির জন্য হাসান মাস্টার একেবারে নদীর তলদেশে মাটির সাথে মিশে যায়। যা ভাবেনি সে তাই হলো। সারাজীবন যে লোকটি অন্যের সন্তানদের শিা দিয়ে এসেছে, যা করতে বলেছে, আর যা করতে সবাইকে বারণ করেছে তা-ই করে ফেলল তার কাস টেনে পড়–য়া মেয়ে সুমি।
সেদিন হাসান মাস্টার শহর থেকে ফিরে বাড়ির উদ্দেশে পারাপার হবে। তখন ঘাটে নৌকা কম। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। নদীর জলে টুপটাপ মুক্তোর দানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। ঘাটের দণি দিকে এমভি রুস্তম আর এমভি বরিশাল নোঙর করা। তারও একটু দূরে কয়েকটা ট্রলার-তাতে হয়তো গম আর কয়েকটায় কীটনাশক সার ভরা। আনলোড হলে এখান থেকে ট্রাকে করে শহরের বিভিন্ন গুদামে চলে যায়। আর গমগুলো যাবে রেললাইনে করে সিদ্ধিরগঞ্জ সাইলোতে। বিশাল সাইলোর পেটে কোটি কোটি মন গম জমা থাকে, আর তা সময়মতো ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন শহরের রেশন শপে চলে যায়।দেশের ভেতর তখন অভাব চার দিকে। রেশন শপের চাল আর গমের জন্য প্রচণ্ড ভিড় লেগে থাকে সবখানে।
তবে হাসান মাস্টারের কোনো অভাব ছিল না সংসারে কিন্তু সেদিন নদীর বহমান গতি থেকে ঝড় সৃষ্টি হয়ে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়।টুপটুপ বৃষ্টি যে কখোন হাসান মাস্টারের মনের নদীতে ঢেউ তুলে সব ডুবিয়ে দিয়েছে তা ভাবতেও পারেনি। হারু মিয়ার দোকানে আজ চায়ের জম্পেস আড্ডা বসেছে। একটু বৃষ্টি আর হালকা বাতাস মানুষের চায়ের তেষ্টা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে, তাই অন্য দিনের চেয়ে আজ ভিড়-বিক্রি বেড়ে গেছে।
হাসান মাস্টার হারু মিয়াকে আগুন গরম এক কাপ চায়ের অর্ডার দেয় এবং ছোট্ট কাচের গ্লাসের মতো কাপ হাতে নিয়ে মুখে দিতেই পাশের বাড়ির আনু মুন্সি তাকে উদ্দেশ করে বলতে থাকেÑ
Ñকি মাস্টার সাব, মাইয়ারে শেষ পর্যন্ত কুলি মজুরের সাথে ভাগাইলেন।
হাসান মাস্টার প্রথম কিছুই বুঝতে পারে না আনু মুন্সির কথা, তবু সে মুখের কাছের এক চুমুক চা গলায় ঢুকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলেন, মুন্সি কার কথা কইলেন?
Ñআরে মাস্টার আপনার মাইয়ার কথা।
Ñকেন আমার মাইয়ার আবার কী হইল ?
Ñও আপনে সারা দিন বাড়িতে ছিলেন না তাইলে ?
Ñনা আমি তো সকালে বাইরে আইছি আর ফিরি নাই।
Ñসকালেই শুনলাম আপনের মাইয়া ভাগছে জরিফ মিয়ার পুলার লগে। কন আপনের মতো শিতি লোকের মাইয়া ওই রিকশাওয়ালার পুতের লগে গেল এইডা কি ভালা কাম হইল।
পাশে বসা অনেকেই আনু মুন্সির কথা কানে নেয়। এই কথা শুনে হাসান মাস্টারের হাত কেঁপে ওঠে, সামান্য চায়ের কাপও ঠিকমতো ধরে রাখতে পারছে না। তার অত দিনকার নিষ্ঠা সততা আর সম্মান মেয়েটা জলে মিশিয়ে দিলো।
সে মাথা নিচু করে দোকান থেকেই বৃষ্টি মাথায় করে বের হলো। আর তার কানে গেল মুন্সির আরেকটি কথাÑ মাস্টার হইলে কী হইব। অন্যের পোলাপান মানুষ কইরা নিজের মাইয়ারেই অমানুষ বানাইল।
হাসান মাস্টারের মাথায় ‘অমানুষ, অমানুষ, অমানুষ’ শব্দটা সিলিং ফ্যানের মতোই ঘুরপাক খেতে লাগল। সে নৌকায় উঠতেই কয়েকবার দুলতে থাকে। নদীতে বৃষ্টির পানি, তার চোখের কোণায় পানি, মাথায় পানি, যে হাতে শাসনের বেত ধরত সেই বাহুতে গড়িয়ে পড়ছে পানি। আজ তার সারা গায়ে ঘৃণার পানি সাগরের মতো বইতে থাকে। ওপারে ঘাটে গিয়ে নামার সময় সে পা পিছলে পড়ে যায়। এতে তার পায়ের একটি হাড় ভেঙে যায়। কিন্তু এ সংবাদটি মিডিয়ায় প্রকাশ না পেলেও কয়েক দিন পর ঘটে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা। টিভির পর্দায় ভাসে একটি চিত্র। ‘শীতল্যা নদীর পানিতে একটি লাশ ভাসছে। পাঁচ নাম্বার ঘাটের কাছে পানিতে ভেসে থাকা কচুরিপানা আর অন্য সব ভাসমান ময়লা-আবর্জনার সাথে একজন মেয়ে মানুষের বিকৃত লাশ ফুলে ফেঁপে ছিল। এ সংবাদ হাসান মাস্টারের কানে গেলেও ভাঙা পা নিয়ে ঘাটে এসে তা দেখার সুযোগ হয়নি।তবে মনের ভেতর বারবার সুমির চেহারা উঁকি দেয়ায় তার চোখ বেয়ে পানির ধারা নামে।
এক দিন পরই নাফিজ এসে বাবাকে বলে, ‘বাবা বড় সুসংবাদ আনছি, দোয়া করো। আগামী সপ্তায় যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি হয়ে লন্ডন যাইতেছি। আমার অফিস সব ব্যবস্থা করতেছে।’ হাসান মাস্টার ছেলের এই খবরে এবারো চোখের পানি ফেলেন। তবে এ পানি বেদনার নয়, আনন্দের।
২৩ মার্চ/২০১৩/নিউজরুম.