২১ মার্চ, ২০১৩।।
বর্তমান সরকারের আমলে গণহারে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ওপর নানাধর্মী হয়রানি ও দমন-পীড়ন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে এবং সময়ের সাথে এর তীব্রতা কেবলই বেড়ে চলেছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে পুলিশ-বিজিবির হাতে শতাধিক বিক্ষোভকারী নিহত হওয়ার পর এই প্রক্রিয়া আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। এখন গণগ্রেফতার ও মুক্তিবাণিজ্য নামের নতুন নতুন পদবাচ্য বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। এখন কোথাও কিছু ঘটলেই তা বিরোধী দল করেছে বলে বিপুলসংখ্যক বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর নামোল্লেখ করে এবং আরো কয়েক শত কিংবা কয়েক হাজার অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নিয়ম চালু হয়েছে। এভাবে সারা দেশে শত শত মামলা করে গণহারে বিরোধী দলের নেতা, কর্মী ও সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এর ফলে গণগ্রেফতারের চরম এক আতঙ্ক বিরাজ করছে দেশজুড়ে। এসব মামলায় শত শত কিংবা হাজার হাজার অজ্ঞাতনামাকে আসামি করার ফলে কে গ্রেফতার হবেন কে হবেন না, সে আতঙ্ক বিরাজ করছে সারা দেশে।
মামলা করার সময় আসামির জায়গায় ‘অজ্ঞাত’ শব্দ ব্যবহার করে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বর্তমানে চলছে রমরমা আটক ও মুক্তিবাণিজ্য। বিভিন্ন এলাকায় মামলায় কাদের আসামি করা হবে, সে ক্ষেত্রে পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত আক্রোশ, শত্রুতা ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিকেও প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। অনেক এলাকায় টুপি-দাড়িওয়ালা মুসল্লি, মাদরাসার ছাত্র, আলেম-ওলামা, ইমাম-মুয়াজ্জিনদের হয়রানি করা হচ্ছে। বিদ্যমান এ পরিস্থিতি তুলে ধরে দৈনিক মানবজমিন গতকাল ‘টাকা দিলে খালাস, না দিলে আসামি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
দৈনিক মানবজমিন উল্লিখিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, “শুরু হয়েছে পুলিশের নয়া ধাঁচের বাণিজ্য। ‘অজ্ঞাত’ আসামি গ্রেফতার ও মামলায় জড়িয়ে টাকা আদায়ের ফন্দি এটি। রাজনৈতিক ও নাশকতার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় এ অজ্ঞাত আসামি হিসেবে ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী, কর্মজীবী মানুষ কেউ বাদ যাচ্ছেন না। রাস্তা থেকে সন্দেহভাজনকভাবে আটক করে থানায় নেয়ার পরপরই শুরু হয় টাকা আদায়ের কৌশল প্রয়োগ। চাহিদামতো টাকা আদায় হলেই খালাস। আর টাকা না দিলে আদালতে চালান। ‘অজ্ঞাত’ আসামির তালিকায় জড়ানো হচ্ছে মামলায়। বিরোধী দলের হরতাল, অবরোধ এবং জামায়াত-শিবিরের সহিংস রাজনৈতিক তৎপরতা শুরুর পর থেকে পুলিশের এ গ্রেফতার বাণিজ্যের মাত্রা বেড়েছে।” সুদীর্ঘ এই প্রতিবেদন এখানে উপস্থাপনের কোনো অবকাশ নেই। তবে প্রসঙ্গত, একই প্রতিবেদনের একটি পার্শ্বপ্রতিবেদনে মানবজমিনের উল্লিখিত তথ্য এখানে উপস্থাপন জরুরি। ওই পার্শ্বপ্রতিবেদনটির শিরোনামÑ ‘গ্রেফতার আতঙ্কে হরিণাকুণ্ডে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দুই শতাধিক ইমাম’। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গ্রেফতারের ভয়ে ঝিনাইদহ হরিণাকুণ্ডের দুই শতাধিক ইমাম পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের গ্রেফতারে পুলিশ দফায় দফায় মসজিদে হানা দিচ্ছে। পাশাপাশি হরিণাকুণ্ডের আট ইউনিয়নের ১৩০ গ্রামে চলেছে পুলিশি আতঙ্ক। গ্রামের পর গ্রাম পুরুষশূন্য।’
উল্লেখ্য, গত ৩ মার্চের জামায়াতের ডাকা হরতালে বিক্ষোভকারীদের হাতে একজন পুলিশ নিহত হওয়ার হামলায় ২০০ জনের নামোল্লেখ করে ও ৬০০০ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ এ পর্যন্ত ৫৬ জনকে আটক করেছে। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি ১৭ জন। বাকিরা গ্রামের সাধারণ মানুষ। একে পুঁজি করে ছাত্রলীগ-যুবলীগের একশ্রেণীর নেতাকর্মী বাণিজ্যে নেমেছেন। আর পুলিশি বাণিজ্য তো রয়েছেই। বিরোধী দলের সরকারবিরোধী আন্দোলন যতই জোরদার হচ্ছে, এই হামলা-মামলা-গ্রেফতার আতঙ্ক ও মুক্তিবাণিজ্যও জোরদার হতে শুরু করেছে।
আমরা মনে করি, অচিরেই এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার। বন্ধ হওয়া দরকার ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামি করার নামে সাধারণ মানুষের ওপর হয়রানি। না হলে সময়ের ব্যবধানে তা রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতাকেই বাড়িয়ে তুলবে। এর পরিণতি কখনোই ভালো হতে পারে না। দমন-পীড়নের রাজনীতি দিয়ে পৃথিবীতে কেউ লাভবান হতে পারে না; বরং তা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে। তা ছাড়া সাধারণ নিরীহ মানুষ অকারণে দুর্ভোগের শিকার হবেন, তা-ও মেনে নেয়া যায় না।