মোট ৯ একর আয়তনের ছোট ছোট ছয়টি জলমহাল ইজারা দেয়ায় ৩০০ একর বোরো জমিতে পানি সেচসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক কৃষক। ইজারাদারেরা মাছ ধরার নামে ফালগুন-চৈত্র মাসেই জলমহালগুলো পানি শুকিয়ে ফেলে। যার কারণে অন্তত ৩০০ একর বোরো জমি পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। অনেক কৃষক নিজের ফলানো বোরো ধান কেটে গরুকে খাওয়াচ্ছেন। আবার অনেকে সময়মতো পানি না পাওয়ার আশঙ্কায় বোরো ধানই রোপণ করেননি।
হবিগঞ্জের পইল ইউনিয়নের খুটিয়ারডুবি হাওরে পাঁচশতাধিক কৃষকের বোরো জমির পরিমাণ প্রায় ৩০০ একর। ৩০০ একর জমিতে প্রতি বছর অন্তত দুই হাজার মণ ধান উৎপাদন করতেন কৃষকেরা। দুই হাজার মন ধানের বাজারমূল্য প্রায় সোয়া কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছর এসব জমি থেকে ৩০০ মণ ধানও ঘরে তোলা সম্ভব হবে না জানিয়েছেন তারা। কৃষকদের অভিযোগ-খুটিয়ারডুবি হাওরে ছয়টি জলমহাল রয়েছে। এসব জলমহালই বোরো জমিতে পানির সেচের একমাত্র অবলম্বন।২০১২ সালে তিন বছরের মাত্র ১০ হাজার ২১০ টাকায় ছয়টি জলমহাল ইজারা দেয় উপজেলা প্রশাসন। ইজারাদারেরা মাছ আহরণের সুবিধার্থে ফাল্গুন-চৈত্র মাসেই জলমহালগুলো শুকিয়ে ফেলে। জলমহাল শুকিয়ে ফেলায় কৃষকদের এ ভোগান্তি।
পইল ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার মর্তুজ আলী বলেন, ১০ হাজার টাকার জন্য সরকার শত শত কৃষকের পেটে লাথি মেরেছে।
কৃষক নিপেষ দাস খুটিয়ারজুরি হাওরে তিন একর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ করেছেন।ইতোমধ্যে তার দেড় একর জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। বাকি জমিও ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তিনি বলেন, এখন অন্ধকার দেখছি। জমির বোরো ধান গরুকে খাওয়াচ্ছি।কৃষক ময়না আহমেদ সাগর জানান, বোরো জমি চাষাবাদ করলে সময়মতো পানি পাওয়া যাবে না এ আশঙ্কায় তিনি বেশির ভাগ জমি ফেলে রেখেছেন। যে জমিতে বোরো চাষাবাদ করেছেন তাও গরুর খাদ্যে পরিণত হয়েছে। কৃষক অবনী দাসের প্রায় সব জমি ফেটে গেছে। কোনো কোনো জমিতে এখন ধুলাবালু ওড়ে। কৃষক প্রতাপ দাস বোরো ধান রোপণের জন্য জমি প্রস্তুত করার পরও ধান রোপণ করেননি। আশঙ্কা, বিলগুলো ইজারা দেয়ায় সময়মতো জমিতে পানি দিতে পারবেন না তিনি। এখন এসব জমি ঘাসের জমিতে পরিণত হয়েছে।
কৃষকেরা জানান, কিছু দালালের মাধ্যমে কৃষকদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে সরকার জলমহালগুলো লিজ দিয়েছে। এতে ৫০০ কৃষকের হাজার হাজার মণ ধান নষ্ট হচ্ছে। দালালেরা মামলা মোকাদ্দমা করে এবং বিভিন্ন সময় চাঁদা কালেকশন করে। এ ব্যাপারে কৃষকেরা এমপি, ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। কোনো কাজ হয়নি।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমদুল হক জানানÑ বর্তমানে এলাকায় কোনো জলমহাল নেই। জলমহাল শুধু কাগজপত্রে। বাস্তবে এসব ডোবা। তবুও তা ইজারা দেয়া হচ্ছে।অসৎ উদ্দেশ্যে এগুলো ইজারা দেয়া হয়। তাতে আশপাশের জমিতে ফসল ফলানোতে বিঘœ সৃষ্টি হয়। বন্দোবস্ত দেয়ার আগে ভালো করে জরিপ করা দরকার ছিল।প্রশাসনের কর্তব্য ছিলÑ ইজারা দেয়ার আগে তারা সরেজমিন তদন্ত করে দেখবে সেগুলোতে ফিশারির উপযুক্ত কি না। যাচাই-বাছাই করে ইজারা দিলে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুরতি হবে। সরকার ছয়টি জলমহাল ইজারা দিয়ে পেয়েছে ১০ হাজার টাকা, আর কৃষকদের তি হবে কোটি টাকা।
সরকারের পে লিজদাতা হবিগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুর রহমান জানিয়েছেনÑ সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্যই জলমহালগুলো ইজারা দেয়া হয়েছে। ইজারার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা বাতিল করাও সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, কাগজপত্রে যে জলমহালগুলো ইজারা দেয়ার বিধান রয়েছে, তা আমার একার সিদ্ধান্তে ইজারা দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারি না। এখানে সরকারের স্বার্থ জড়িত। তবে কোনো জলমহালের পানি যদি সাধারণ মানুষের কৃষিকাজে ব্যবহার করা ছাড়া উপায় থাকে না, সেগুলো যাতে ভবিষ্যতে ইজারা দেয়া না হয় সে জন্য আমি ওপর মহলে লিখতে পারি। এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন একমাত্র বিভাগীয় কমিশনার। আর যে জলমহাল ইজারা দেয়া হয়ে গেছে, সেগুলো আর বাতিল করার সুযোগ নেই। এ েেত্র ইজারা বাতিল করা হলে ইজারাদার, আদালতে মামলা মোকাদ্দমা করতে পারেন। মামলা মোকাদ্দমা করলে এর নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে।
২১ মার্চ/২০১৩/নিউজরুম.