নবমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন অভিনেতা আলমগীর। চলচ্চিত্রের অতীত-বর্তমান, পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি ইত্যাদি নিয়ে ‘আনন্দ’-এর সঙ্গে কথা বললেন তিনি
সেরা অভিনেতা হিসেবে নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। একটানা পেয়েছেন চারবার। সর্বশেষ কে আপন কে পর চলচ্চিত্রে সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন ২০১১ সালে। মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল গমগমে কণ্ঠস্বর, ‘আমি তো ফোনে ইন্টারভিউ দিই না। বাসায়ও কথা বলব না, বারিধারায় আমার অফিসে আসতে হবে।’ ফোনে আমরা সাক্ষাৎকার নিতেও চাইনি। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ কথা বলব, এ জন্য সময় ঠিক করতেই ফোন করা। পরে শনিবার তাঁর অফিসে তাঁর সঙ্গে জমে উঠল অনেক কথার আসর। এখানে আমরা অভিনেতা আলমগীরকে নয়, যেন বা পেলাম ব্যবসায়ী আলমগীরকে।নিজের প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম দেখভাল করতে করতে বললেন, ‘আমি তো এখন ফিল্ম করি না, আমার কাছে কী?’
আলমগীরের গলায় কি আক্ষেপ, অভিমান? নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার পর কিসের অভিমান তাঁর? না, এরপর তিনি যে কথাগুলো বলবেন, তা আক্ষেপ-অভিমানের নয়, আমাদের চলচ্চিত্রের একটি খামতিকে আরও খোলাসা করে তুলে ধরবেন তিনি।
‘আমাদের চলচ্চিত্রে কিছু সমস্যা হলো, আমি, রাজ্জাক ভাই, ফারুক—আমরা যাঁরা একসময় নায়ক ছিলাম, বয়সের কারণে আমরা তো এখন আর নায়ক নই; কিন্তু গল্পের নায়ক হওয়ার মতো ম্যাচিউরিটি আমাদের সবার আছে। আমাদের নিয়ে এমন নিরীক্ষামূলক ছবি এখন কে নির্মাণ করবেন? না আছে সে রকম পরিচালক, না আছে চিত্রনাট্যকার। অথচ পাশের দেশ ভারতে উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ বচ্চন—এঁদের কেন্দ্রে রেখে ভূরি ভূরি ছবি হয়েছে।’
পাঠক, আলমগীর প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন ১৯৭২ সালের জুন মাসে আমার জন্মভূমি ছবিতে। প্রথম সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে, মা ও ছেলে চলচ্চিত্রের জন্য। ১৯৮৭-তে অপেক্ষা চলচ্চিত্রে আরেকবার। এরপর ১৯৮৯ থেকে একটানা চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শোভা পেয়েছে তাঁর শোকেসে—ক্ষতিপূরণ (১৯৮৯), মরণের পরে (১৯৯০), পিতা মাতা সন্তান (১৯৯১), অন্ধবিশ্বাস (১৯৯২)। এর এক বছর বিরতির পর আলমগীর আবারও ঘরে তোলেন এ পুরস্কার। তবে এবার ১৯৯৪ সালে দেশপ্রেমিক ছবিতে পেলেন সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার। ২০১০ ও ২০১১ সালে একইভাবে আবারও। সে হিসেবে পুরস্কার যেন তাঁর কাছে অনেকটাই ডালভাত।
চলচ্চিত্রে আপনার প্রাপ্তি কী?
‘মানুষের হাততালি।’ উত্তরটি খুব ছোট হয়ে গেল ভেবেই বুঝি আরেকটু বললেন, ‘আসলে সেই অর্থে একজন অভিনেতার কখনো প্রাপ্তি হয় না, কেউ অভিনেতা হলে মন থেকে কখনো তাঁর আত্মতৃপ্তি আসে না। কারণ, অভিনয়ের যে আকাশ, তা কি এক জনমে ভরাট করা যায়? সেই দিক থেকে আমার প্রাপ্তি ছিল না। একধরনের পাগলামি ছিল—কী পেলাম বা পেলাম না—এসব নিয়ে কখনো ভাবিনি। অর্থটা কোনো দিন মুখ্য ছিল না আমার কাছে।মনের তাগিদে আমরা ছবি করতাম।’
এর মধ্যে চা চলে এসেছে। তিনি বললেন পুরস্কার প্রসঙ্গে। ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে কয়েকটি ক্যাটাগরি আছে—সেরা অভিনেতা, সেরা পার্শ্ব অভিনেতা ইত্যাদি। কিন্তু আমার মনে হয়, পার্শ্ব অভিনেতা বলে কিছু নেই। অভিনেতা তো অভিনেতাই। হওয়া উচিত শ্রেষ্ঠ অভিনেতা প্রধান চরিত্রে, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পার্শ্ব চরিত্রে। হলিউডে এভাবেই পুরস্কার দেওয়া হয়। তাই পুরস্কারের নামগুলো সংশোধন করা উচিত।’
একসময়ের সামাজিক চলচ্চিত্রের এই নন্দিত নায়ক এখন কথা বলছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রে নিজের অভিনীত চরিত্রগুলো নিয়ে।
‘মা ও ছেলে-তে প্রতিবাদী সন্তানের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। পারিবারিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে কাহিনি গড়ে উঠেছিল অপেক্ষা ছবির। দুটো ছবিতেই সঙ্গে ছিলেন শাবানা। ক্ষতিপূরণ করেছিলাম রোজিনার সঙ্গে। একটি শিশুকে নিয়ে ছিল মূল কাহিনি। মরণের পরে পারিবারিক ছবি। একটি দুর্ঘটনায় আমার দুটো হাত নষ্ট হয়ে যায় এখানে…।’
একে একে চরিত্রগুলো সম্পর্কে বলছেন নায়ক।স্মৃতির দরজায় কড়া নেড়ে কোনোটা মনে পড়ছে, কোনোটা পড়ছে না। প্রসঙ্গটি পেছনে ফেলে তাই এতক্ষণে জানালেন খেদের কথা, ‘আমাদের চলচ্চিত্রে অবক্ষয় শুরুর পেছনে পরিচালকদের দায় অনেক। এটি মূলত ডিরেক্টরস মিডিয়া। পরিচালকের কথাই এখানে চূড়ান্ত। তবে পরিচালকেরা যেদিন থেকে প্রযোজকদের বশ্যতা স্বীকার করে তাঁদের আনুগত্য মেনে নিয়েছেন—আমাদের চলচ্চিত্র যখন প্রডিউসারস মিডিয়ায় পরিণত হয়েছে—সেদিন থেকেই অবক্ষয়ের শুরু। মূলত গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে সেটা ঘটেছে।’
তাঁর সোজাসাপ্টা কথার এ তো কেবল আরম্ভ।এরপর বর্তমান চলচ্চিত্র সম্পর্কে তিনি বলবেন, ‘এখন ঢালিউডে শেখানোর মতো মানুষের সংখ্যা কম। নতুন অভিনয়শিল্পীরা আসছে, তাদের মধ্যে শেখার আগ্রহ তৈরি করে দিতে হবে, ভেতর থেকে জাগিয়ে দিতে হবে—সেই মানুষগুলো কোথায়… নেই তো।’
‘একজন অভিনেতাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। তাঁকে জানতে হয় অভিনয় তত্ত্বগুলো। তবেই না দিনে দিনে প্রকৃত “অভিনেতা” হয়ে উঠবে সে।’—নানা কথা আলমগীরের মুখে, ব্যবসায়ী নয়, এখন যেন পুরোদস্তুর এক অভিনেতা কথা বলছেন।
২১ মার্চ/২০১৩/নিউজরুম.