পড়াশোনা শেষে ভালো একটা চাকরি, সংসারী একজন জীবনসঙ্গী, ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের সুতোয় বেঁধে হেসেখেলে স্বপ্নে বিভোর—এই তো সবাই চায়।
কিন্তু এমন আত্মগমন জীবনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছিলেন একজন। আজ থেকে ৪০ বছর আগে। বিদেশে পড়াশোনা শেষে বড় চাকরি শুরু করেছিলেন।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নিপীড়িত ও দরিদ্র মানুষের অবস্থা তাঁকে বিচলিত করে তুলল—বদলে গেল তাঁর সব চিন্তাভাবনা, ধ্যান-ধারণা।
অতীত ভাবনা থেকে বর্তমান আর ভবিষ্যতের অন্য এক মায়াজালে নিজেকে জড়ালেন। নিজস্ব যা কিছু সঞ্চয় ছিল, তা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের বন্যা-খরা-দুর্ভিক্ষপীড়িত জনতার পাশে। শুরু হলো নতুন এক পথচলা। একক, দশক, শতক, সহস্র-লক্ষ-কোটি—না, অঙ্কের কোনো হিসাব না, সব দরিদ্রজনকে আশার আলো দিয়ে জড়ো করলেন এক ছাতার তলে। তিল তিল করে গড়ে তুললেন অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আত্মবিকাশে। সামনে এগিয়ে যাওয়া শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা, শিক্ষা-সততা-কর্তব্যপরায়ণ-ন্যায়নীতি-সর্বোপরি সভ্যতা ও সংস্কৃতির মাঝে বেড়ে ওঠার এক অনন্য দৃষ্টান্ত সবার মাঝে ছড়িয়ে গেল তাঁর নেতৃত্বে।
এ যেন বিন্দু থেকে সাগরে, ছোট্ট চারাগাছ থেকে মহীরুহ রূপে রূপান্তরের এক সগৌরব অগ্রযাত্রা। যাঁর সুশীতল ছায়া আজ বিস্তৃত হয়েছে বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে দেশে-বিদেশেও।
হ্যাঁ, ব্র্যাক এবং তার রূপকার স্যার ফজলে হাসান আবেদ। অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছেন প্রতিটি পরতে। কী নেই ব্র্যাকে?
শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি-মানবসম্পদ উন্নয়ন-অধিকার-জেন্ডার ইস্যু—উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করে চলেছে হাজারও প্রকল্প—যার কর্মী সারা দেশে লক্ষাধিক আর শিক্ষার্থী প্রি-প্রাইমারি, মেধাবিকাশ, ছাত্রবন্ধু, কিশোর-কিশোরী-সারথি—সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ লাখ।
সেই যে ১৯৭২-এ যার যাত্রা, সেই ব্র্যাক আজ মহীরুহরূপে বাংলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে।সুদৃঢ় এক অবকাঠামোতে ও সুদক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থায় ব্র্যাকের কর্মীরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরাও সবার সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে শৃঙ্খলা মেনে চলেন। প্রত্যেকের লক্ষ্য একটাই, প্রতিটি শিশু-কিশোরকে শিক্ষাদান। আর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষ ও মূল্যায়ন। ব্র্যাকের এই উন্নয়ন কার্যক্রম প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক। ঊর্ধ্বতন সবাই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, যেখানে পথ নেই—হাওর, বিলে যেখানে শিক্ষার্থীরা, সেখানেও তাঁদের নিত্য পদচারণা। কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না তার নজরদারি করা, সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া।
স্যার ফজলে হাসান আবেদের অতীত-বর্তমান সবই আজ ব্র্যাক।
‘কেউ কি দেখেছ কখনো এমনতর ভালোবাসা
সুবিধাবঞ্চিত মানবের তরে।’
ব্র্যাক—আমরা গর্বিত-আবেগে আপ্লুত।
কামরুন্নেসা হাসান
কনসালট্যান্ট, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি
সাবেক উপমহাপরিচালক, বিটিভি।
২১ মার্চ/২০১৩/নিউজরুম.