২০ মার্চ, ২০১৩।।
পদ্মা সেতু নিয়ে টানাপড়েনের যেন শেষই হচ্ছে না। একবার ধরনা দেয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের কাছে; আবার বলা হচ্ছেÑ না, আমরা তোমাদের কাছ থেকে ঋণ দেবো না। সংসদে একবার ঘোষণা করা হলো, এ সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করা হবে। অর্থমন্ত্রী তার একটি রূপরেখাও দিলেন। এরপর ক’দিন যেতে-না-যেতেই বলা হলো, নিজের টাকা দিয়ে পদ্মায় সেতু বানানো সম্ভব হবে না। এ সেতুতে বাইরের বিনিয়োগ লাগবেই। সবশেষে মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানি এই সেতুতে বিনিয়োগের জন্য প্রস্তাবের রূপরেখা তুলে ধরেছে। আবার বলা হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব সম্পর্কে কিছুই জানেন না, সব জানেন প্রধানমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী। এতে দেশের মানুষের মন থেকে এই সেতুটি আদৌ হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ কোনোভাবেই যাচ্ছে না।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে দেয়া প্রস্তাবে সেতুর মূল দু’টি কাজে ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়। এর বিপরীতে ৫২০ কোটি ডলার উঠিয়ে নেবে মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিরা সরকারের সাথে দরকষাকষিতে প্রাথমিকভাবে মতৈক্যে পৌঁছেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত কার অর্থে পদ্মা সেতু হবে তা নিয়ে চূড়ান্ত কোনো চুক্তি এখনো হয়নি।
নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী পদ্মা সেতু প্রকল্পের দু’টি উপাদান মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ করবে মালয়েশিয়া। এ কাজে আগের প্রস্তাবের চেয়ে ১৫ শতাংশের মতো বেশি হিসাব করে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। টোল আদায় করে ২৬ বছরে বিনিয়োগের সুদ-আসলসহ ৫২০ কোটি ডলার বা ৪১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা তারা উঠিয়ে নেবে। মালয়েশিয়া তিন বছরে মূল সেতু নির্মাণ করে দেবে। মূল সেতু হওয়ার পর নদীশাসন সম্পন্ন করা হবে, তবে তার আগেই সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি চলাচল করতে পারবে। ২৬ বছর পর এই সেতু বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। মালয়েশিয়া মূলত মূল সেতু নির্মাণে ১৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। সেতু নির্মিত হওয়ার পর টোল আদায় শুরু হলে সেই টাকায় নদীশাসনের কাজ করা হবে। বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সাথে করা চুক্তি অনুযায়ী, প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে মূল সেতু ও নদীশাসনে সে সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১০ কোটি মার্কিন ডলার। আর সংযোগ সড়ক, সার্ভিস এলাকা নির্মাণ, জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসনসহ আনুষঙ্গিক খরচ ধরা হয় ৮০ কোটি মার্কিন ডলার। এই অর্থ ব্যয় করার কথা ছিল বাংলাদেশের। নতুন প্রস্তাব অনুসারে বাংলাদেশ অর্থ পাওয়া শুরু করবে সেতু নির্মাণ শেষ হওয়ার পাঁচ বছর পর। প্রথম পাঁচ বছর টোলের পুরোটাই চলে যাবে মালয়েশিয়ার ভাগে। মালয়েশিয়া ২৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে সে দেশের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করা হবে প্রথম পাঁচ বছরে। প্রকল্পে আয়ের প্রাথমিক হিসাব অনুসারে আয় না হলে বাংলাদেশ সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে তা পূরণ করতে হবে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতা সংস্থা ঋণের যে প্রস্তাব দিয়েছিল তাতে বাংলাদেশকে সার্ভিস চার্জ দিতে হতো অনেক কম। ফলে এই ঋণের জন্য বাংলাদেশকে কম অর্থ ব্যয় করতে হতো। এতে সেতু দিয়ে চলাচলকারী গাড়ির টোলের অঙ্কও তুলনামূলক কম হতো। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের সাথে ঋণ এবং এই প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে টানাপড়েনে ইতোমধ্যে যে সময় পেরিয়ে গেছে তাতে ১৫ শতাংশের মতো ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে আরো যত দেরি হবে ততই বাড়বে খরচ। আর রেয়াতি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে যে ব্যয় হবে তার চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যিক বিবেচনার ঋণে সুদজনিত ব্যয় হবে অনেক বেশি। মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক শর্তের বিবেচনায় ২৬ বছরে বিনিয়োগের সোয়া দুই গুণ তুলে নেয়ার প্রস্তাব তা খুব বেশি অযৌক্তিক নয়। আর মূল সেতু নির্মাণ করে নদীশাসন কাজে কারিগরিভাবে সেতুর যদি কোনো ক্ষতি না হয় তাহলে ব্যয়সাশ্রয়ের জন্য সেটি করা যেতে পারে। তবে ভাবনার বিষয় হলো, সরকারের উচ্চমহলের দুর্নীতির জন্য দেশের কতটা মূল্য দিতে হচ্ছে সেটি। এ জন্য ঋণব্যয়ে কম করে হলেও চার গুণ মূল্য তো দিতেই হচ্ছে। এর পরও আমরা মনে করি যা গেছে চলে গেছে, তা নিয়ে হা-হুতাশ করে সময়ের অপচয় করা আর ঠিক হবে না। পদ্মা সেতু নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসতেই হবে। যত সময় যাচ্ছে এর জন্য প্রদেয় মূল্যের অঙ্কও বাড়ছে। আর এ ধরনের প্রকল্প থেকে কমিশন আদায়ের মনোবাসনার কারণে জাতিকে যেন এ রকম বড় অঙ্ক ও স্বপ্ন ভাঙার মূল্য দিতে না হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।