স্পোর্টস ডেস্ক শ্রীলঙ্কার টেস্ট দল ঘোষণার পর ক্রিকইনফোতে করা মন্তব্যে এক শ্রীলঙ্কান চাওয়াটা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন। দুই টেস্টেই ইনিংসে জিততে হবে। ওয়ানডে সিরিজ শুধু ৩-০ জিতলেই হবে না, প্রতিটি ম্যাচই জিততে হবে ৫ বা এর বেশি উইকেটের ব্যবধানে এবং কমপক্ষে ৫ ওভার হাতে রেখে (যেন তিনি জানেন, সব ম্যাচেই শ্রীলঙ্কা পরে ব্যাট করবে!)। টি-টোয়েন্টিতেও অবশ্যই জয়, তবে ‘ভদ্রতা’ করে শুধু এটির ফলাফলই সুনির্দিষ্ট করে দেননি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সমর্থকেরা খুব আবেগপ্রবণ। ওই শ্রীলঙ্কানের মন্তব্য নিশ্চয়ই তাদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে থাকবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস যখন সামনে এসে দাঁড়াচ্ছিল, অমন একটা কিছুর শঙ্কা কি তাদেরও মনের কোণে উঁকি দিয়ে যায়নি!
টেস্ট সিরিজ শেষ হলো। এই প্রথম স্কোরলাইন শ্রীলঙ্কা ২-বাংলাদেশ ০ নয়।বাংলাদেশের সঙ্গে সিরিজ ড্র করার দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাওয়া অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস কাল সংবাদ সম্মেলনে নিজে থেকেই বললেন, ‘ওয়ানডে সিরিজটাও হবে খুব চ্যালেঞ্জিং।’
‘সিরিজটাও’ শব্দটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, টেস্ট সিরিজ জেতাটাও শ্রীলঙ্কার নতুন অধিনায়কের কাছে কম ‘চ্যালেঞ্জিং’ মনে হয়নি। এটা কে না জানে যে, টেস্টের চেয়ে ওয়ানডেতে বাংলাদেশ অনেক ভালো দল। টেস্ট সিরিজ জিততেই এমন ঘাম ঝরাতে হওয়ার পর ওয়ানডে সিরিজ তো ম্যাথুসের কাছে ‘চ্যালেঞ্জিং’ মনে হওয়ারই কথা।
টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে থেকেই ‘বাংলাদেশ ভালো দল’ ‘বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে’ বলে যাচ্ছিলেন। গলে প্রথম টেস্ট ড্র হওয়ার পর সে কথা মনেও করিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে একটুও বিস্মিত নন বলেও দাবি করেছেন। সেটি যে শ্রীলঙ্কা দলের মনের কথা ছিল না, সেটি কাল পরিষ্কার হয়ে গেল কুমার সাঙ্গাকারার মন্তব্যে। প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ যে সত্যিকার এক বিস্ময় হয়ে এসেছে, সেটি স্বীকার করলেন এই সিরিজে দুই দলের মূল পার্থক্য গড়ে দেওয়া বাঁহাতি।
কিন্তু কলম্বোতে দ্বিতীয় টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পর কেন প্রথম টেস্টের জাবর কাটা? প্রেমাদাসায় নামার আগেই তো মুশফিকুর রহিম বলে দিয়েছেন, ‘প্রথম টেস্ট এখন ইতিহাস।’ তার পরও, দ্বিতীয় টেস্টে চার দিনের মধ্যে ৭ উইকেটে পরাজয়ের পরও গল টেস্ট তার সব মহিমাসহ ফিরে আসছে। কারণ, সময় এখন পুরো টেস্ট সিরিজের দিকে ফিরে দেখার।
মুশফিকুর রহিমও যে তা করতে গিয়ে গলে ফিরে যাবেন, এ তো জানা কথাই, ‘সিরিজের শুরুটা খুব ভালো ছিল। ইতিবাচক অনেক কিছু ছিল।’ কলম্বোর হতাশায় গলের অর্জন অবশ্য কিছুটা হলেও ঝাপসা দেখাচ্ছে তাঁর মনে। দ্বিতীয় ইনিংসে আরও ভালো ব্যাটিং করে শ্রীলঙ্কাকে কমপক্ষে ২৫০ রানের একটা লক্ষ্য ছুড়ে দিতে পারলে ভালো একটা ‘ফাইট’ দেওয়া যেত বলে আক্ষেপ করলেন। তবে আসল আক্ষেপটা প্রথম ইনিংস নিয়ে। ম্যাচটা যে হাত থেকে বেরিয়ে গেছে সেখানেই, ‘প্রথম ইনিংসে উইকেট আরও ভালো ছিল। কিন্তু আমাদের স্কোরটা ৮০ থেকে ১০০ রানের মতো কম হয়ে গেছে।সেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন ছিল। আমাদের বোলিং আক্রমণ তো আর এমন নয় যে, নিজেরা ২৪০ রান করে ওদের ২০০ রানে অলআউট করে দেব।’
মুশফিকুরের মাথাটা খুব পরিষ্কার। দলের সমস্যাটা কোথায়, করণীয় কী—সবই তাঁর জানা। সেটি বললেনও খুব গুছিয়ে। গলে তিনি নিজে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন, আশরাফুল ১৯০। আর এখানে সর্বোচ্চ মমিনুলের ৬৪। সবার সামনে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরলেন সাঙ্গাকারাকে, ‘একটু আগেই সাঙ্গাকারা যেমন বলল, সেটির রেশ ধরেই বলি, যার সঙ্গেই খেলি মনোসংযোগ যেন ঠিক থাকে।’ স্পিনারদের জন্যও উদাহরণ প্রতিপক্ষ দলেই খুঁজে পেলেন, ‘এই উইকেটে আমাদের স্পিনারদের আরও ভালো বোলিং করা উচিত ছিল। হেরাথকে দেখেই ওরা শিখতে পারে, এক জায়গায় বোলিং করে গেলে কী হয়।’
এটা কোথায় পার্থক্য গড়ে দেয়, সেটিও বললেন খুব সুন্দর করে, ‘টেস্টে প্রথম ১০-১৫টা রান খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন ব্যাটিং করি, তখন তা করা খুব কঠিন হয়ে যায়। কারণ, ওদের বোলাররা ওভারের পর ওভার ঠিক জায়গায় বল করে যায়। কিন্তু ওরা যখন ব্যাটিং করে, এই চাপটা তৈরি হয় না। কারণ ওরা জানে, ওভারে একটি-দুটি বাজে বল পাবেই।’
সমস্যাটা জানেন, তা সমাধান করতে করণীয়ও। আরও বেশি বেশি টেস্ট খেলাতেই এর সমাধান দেখছেন মুশফিকুর, ‘বছরে দুটা-চারটা টেস্ট খেলে এসব ঠিক করা কঠিন।বছরে অন্তত আট থেকে ১০টি টেস্ট খেলতে পারলে আমরা নিজেদের ভুলগুলো শোধরাতে পারব। আপনি যতই ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি খেলুন না কেন, টেস্ট ক্রিকেটটাই হলো মূল জায়গা।’
বাংলাদেশের অক্ষমতা তো আছেই, এই টেস্টে আম্পায়ারিংটাও ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’ হয়ে এসেছে মুশফিকুরের কাছে। শাস্তির ভয়ে অধিনায়কেরা সংবাদ সম্মেলনে সাধারণত আম্পায়ারিংয়ের সমালোচনা করেন না। কিন্তু মুশফিকুর সরাসরিই বলে ফেললেন, ‘আজ মমিনুল আউট ছিল না। সব দলের সঙ্গেই এমন হয়। তবে আমাদের মতো ছোট দলের বিপক্ষে এমন ভুল হলে সেটির ধাক্কা আর আমরা সামলে উঠতে পারি না।’ প্রথম ইনিংসে সাঙ্গাকারার বিপক্ষে একটি এলবিডব্লু না পাওয়া নিয়েও ক্ষোভ আছে বাংলাদেশ শিবিরে। সেটির দিকে ইঙ্গিত করতেও ছাড়লেন না মুশফিকুর।
সমাধান হতে পারে একমাত্র ডিআরএস। বাংলাদেশ দল যা নিজেদের দেশে পায় না, এখানেও পাচ্ছে না। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের যে বিসিবির চেয়েও বেশি টানাটানির সংসার!
(২০ মার্চ): নিউজরুম