স্পোর্টস ডেস্ককোথাও নেই ট্রফিটা। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ছোট হয়ে আসা বিসিবির কার্যালয়ের শো-কেসে নেই। নেই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মূল কার্যালয়ের প্রবেশপথে সাজিয়ে রাখা ট্রফিগুলোর সঙ্গেও। স্টোর রুমে ধুলোয় মলিন যে দু-তিনটা ট্রফি পড়ে আছে, সেখানেও খুঁজে পাওয়া যায়নি এই ট্রফি। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান স্মারক ১৯৯৭-এর আইসিসি ট্রফি তাহলে কোথায়? কেউ বলছেন, হারিয়ে গেছে, কেউ বলছেন, বাংলাদেশে নাকি এই ট্রফি আসেইনি!
১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রায় বড় এক মাইলফলক। সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত করেছিল বাংলাদেশ দল। এরপর কুয়ালালামপুরের কিলাত কেলাব মাঠের ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে অধিনায়ক আকরাম খান উঁচিয়ে ধরেন আইসিসি ট্রফি।আইসিসি জয়ী দলের খেলোয়াড় এবং সাবেক-বর্তমান বোর্ড কর্মকর্তারা এখন কেবল ট্রফি উঁচিয়ে ধরার ওই ছবিটাই মনে করতে পারেন। পরবর্তীকালে ট্রফিটা কোথায় গেল, সেই স্মৃতি মুছে গেছে সবারই।
২০১১ বিশ্বকাপের আগে বোর্ড কার্যালয়ের শোভাবর্ধনের জন্য অন্যান্য ট্রফির সঙ্গে আইসিসি ট্রফিও প্রদর্শনীতে রাখার পরিকল্পনা হয়। তখনই ধরা পড়ে, ট্রফিটা বিসিবির কোথাও নেই। এরপর গত বছরের ৯ জুলাই ’৯৭-এর আইসিসি-জয়ী দলকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আগে আরেকবার খোঁজ পড়ে ট্রফির। পাওয়া যায়নি তখনো।বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের উজ্জ্বলতম তারকাদের উপস্থিতিতে আলো-ঝলমলে ওই অনুষ্ঠানে একমাত্র খুঁত ছিল ট্রফির অনুপস্থিতি।
‘নিখোঁজ’ আইসিসি ট্রফির সন্ধানে নেমে গত কয়েক দিনে কয়েক রকম বক্তব্য পাওয়া গেছে। বিস্ময় সেখানেও। ট্রফি কোথায়, সে প্রশ্ন তো পরে; আইসিসি জয়ের পর বাংলাদেশে আসল ট্রফি এসেছিল, নাকি রেপ্লিকা, নাকি আসেনি কোনো ট্রফিই—এর কোনোটারই স্পষ্ট উত্তর দিতে পারছেন না বিসিবির কেউ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ’৯৭-র বোর্ড এবং বর্তমান বোর্ডেও থাকা এক কর্মকর্তা বললেন, ‘ট্রফিটা দলের সঙ্গে এসেছিল কি না মনে নেই। এসব টুর্নামেন্টে তো আসল ট্রফি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের পর রেখে দেওয়া হয়। জয়ী দলকে পরে রেপ্লিকা দেওয়া হয়।’ আইসিসি রেপ্লিকা দিলে সেটাও থাকা উচিত ছিল বিসিবির কাছে। অথচ মূল ট্রফি বা রেপ্লিকা, কোনোটাই নেই কোথাও। তবে আইসিসি জয়ের একটা স্মারক ট্রফি যে বাংলাদেশে এসেছিল, সেটা নিশ্চিত করে বলেছেন অনেকেই। পরবর্তী সময়ে বিসিবির কার্যালয়ে সাজিয়ে রাখা ওই ট্রফি দেখা দর্শকের সংখ্যাও কম নয়।
আইসিসি ট্রফিজয়ী দলের ম্যানেজার গাজী আশরাফ হোসেন বর্তমানে বিসিবির অস্থায়ী কমিটির সদস্য। বাংলাদেশ দলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা সফরে আছেন তিনি। সেখান থেকেই পরশু টেলিফোনে জানালেন, ‘যত দূর মনে পড়ে, মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরার সময় আমাদের সঙ্গে ট্রফি ছিল না। তবে পরবর্তী সময়ে একটা ট্রফি এসেছিল…সম্ভবত রেপ্লিকা। ট্রফিটা আমি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দেখেছি।’ অস্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মাহবুবুল আনামও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অফিস থাকার সময় ট্রফি দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। সাবেক বোর্ড সদস্য রিয়াজ উদ্দিন আল মামুনের স্মৃতি আরেকটু তাজা। টেলিফোনে জানালেন, ২০০১ সালে বিসিবির মূল কার্যালয় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে গুলশানের নাভানা টাওয়ারে স্থানান্তরিত হওয়ার পরও ট্রফিটা তাঁর চোখে পড়েছে, ‘নাভানা টাওয়ারে অফিস থাকার সময় ট্রফিটা বিসিবিতে ছিল।প্রথমে এটা ছিল বোর্ড সভাপতির রুমে। পরে বোর্ডরুমে নেওয়া হয়।’
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ও নাভানা টাওয়ারে অনেকে আইসিসি ট্রফি দেখলেও বিসিবির কার্যালয় মিরপুরে আসার পর সেটা দেখেনি কেউ। কারও কারও দাবি, ঘটনাটা ২০১১ সালে নাড়া পড়লেও ২০০৭ সালে গুলশান থেকে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বিসিবির কার্যালয় স্থানান্তরের সময়ই খোয়া গেছে সেটা। ওই সময় জিনিসপত্র আনা-নেওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, বিসিবির এমন এক কর্মচারীর ভাষ্য, ‘নাভানা টাওয়ারে আমি নিজে আইসিসি ট্রফি দেখেছি, কিছুদিন আগে ট্রফি খোঁজাখুঁজির সময় বসদেরও বলতে শুনেছি, তাঁরা আগের অফিসে এটা দেখেছেন। এর পরও কীভাবে কী হয়ে গেল, জানি না।’ শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ভেন্যু প্রশাসক আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকির নিশ্চিত করেছেন, মিরপুরে আইসিসি ট্রফি দেখেননি তিনিও, ‘২০০৮ সালে আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময় আইসিসি ট্রফি ছিল না। অন্য ট্রফিগুলো আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলেও এটা দেওয়া হয়নি।’
আইসিসি ট্রফির ব্যাপারে জানতে চাইলে বিসিবির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজামউদ্দিন চৌধুরী দুই রকম কথা বলেছেন। পরশু বললেন, ‘আইসিসি ট্রফি এখন বিসিবিতে নেই। কোথায় আছে, তা-ও বলতে পারছি না। বলব না যে, এটা চুরি হয়ে গেছে। কোথাও নিশ্চয়ই আছে। আমরা ট্রফিটা খুঁজছি।’ কাল বললেন অন্য কথা, ‘শুনেছি, আইসিসি জয়ের পর কোনো ট্রফি বাংলাদেশে আসেনি।’
আইসিসি ট্রফি আদৌ বাংলাদেশে এসেছে কি না, আসলে সেটা কোথায়—এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর নেই বিসিবির কারও কাছেই। অনেকের মনে সংশয়, ইতিহাসের সাক্ষী এই ট্রফি হয়তো ঢুকে গেছে কারও ‘ব্যক্তিগত সংগ্রহে’র তালিকায়। যেখানেই থাকুক, আইসিসি ট্রফি নিয়ে ধূম্রজাল আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, ইতিহাস সংরক্ষণে কতটা উদাসীন বিসিবি। ট্রফি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ এখনো নেই। আশঙ্কা জাগে, এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অন্য ট্রফিগুলোর রাশিচক্রেও হয়তো ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার পরিণতিই লেখা আছে।
(২০ মার্চ): নিউজরুম