সংকটে সোনালী ব্যাংক

0
163
Print Friendly, PDF & Email

দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের এখন বেহাল অবস্থাখেলাপি ঋণ পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছেবেড়ে গেছে মূলধন ঘাটতিলোকসানের পরিমাণও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে
সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋন এখন ১৩ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৪০ ভাগমূলধন ঘাটতি প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকাআর ব্যাংকটির লোকসান এখন দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি
হল-মার্কসহ কয়েকটি ঋণ কেলেঙ্কারি ব্যাংকটিকে এ অবস্থায় ফেলে দিয়েছেঋণ জালিয়াতি ছাড়াও প্রভাব বিস্তারে ঋণ বিতরণ, অবাস্তব সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা দিয়ে পুনঃ তফসিলসুবিধা প্রদান, সব ধরনের নিয়মনীতি উপেক্ষা এবং পুনঃ তফসিলের কিস্তি সঠিকভাবে পরিশোধ না করায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছেসোনালী ব্যাংকে এসব অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে
ব্যাংক পরিচালনায় ভয়াবহ ব্যর্থতার কারণেই সোনালি ব্যাংকের এই পরিণতিবড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়ে গেছে বৃহত্তম এই ব্যাংকটিপরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে সরকার মূলধন না জোগালে সোনালী ব্যাংকের চলাই এখন কষ্টকর
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সোনালী ব্যাংকের এই পরিস্থিতির জন্য মালিক হিসেবে সরকারকে দায়ী করেনতিনি বলেন, ‘সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নিয়োগ দেয়অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এই নিয়োগের ক্ষেত্রে সততা ও দক্ষতার প্রমাণ রাখতে পারেনিঅস্বচ্ছতাও আছেতাই প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে সরকারেরসরকারের পরে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সোনালী ব্যাংকের এ অবস্থার জন্য দায়ী বলে আমি মনে করি
ইব্রাহিম খালেদ আরও পরিষ্কার করে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির দায়ে বরখাস্তকৃত ডিএমডি মাইনুল হক রূপালী ব্যাংকের জিএম ছিলেনসেখান থেকে তাঁকে এনে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি করা হয়মাইনুল হক ট্রুথ কমিশনে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কীভাবে একজন আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজকে সোনালী ব্যাংকে ডিএমডি নিয়োগ দেয়? তাদের ব্যর্থতার কারণেই ব্যাংকটির এ অবস্থা হয়েছে
নতুন করে খেলাপি ঋণ: কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, গুণমান ভালো না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে সোনালী ব্যাংকের এক হাজার ৩১৩ টাকার ঋণকে খেলাপি চিহ্নিত করেছেসম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের ১২টি শাখা পরিদর্শনে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল বেশ কিছু পুনঃ তফসিল করা ঋণে অবাস্তব সময় প্রদান, কিস্তি পরিশোধ না করা বা কিস্তির আংশিক অর্থ পরিশোধ করার কারণে এসব ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করে
এ নিয়ে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ (২০১২ সালের ভিত্তিতে) বেড়ে হয়েছে ৩৯ দশমিক ৩৫ শতাংশপরিমাণের দিক থেকে তা ১৩ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকাএর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১২ সালভিত্তিক শ্রেণীকৃত ঋণ ও নিরাপত্তা সঞ্চিতিপ্রতিবেদনে সোনালী ব্যাংকেরই পাঠানো তথ্য-উপাত্ত ধরে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৪৫ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ উল্লেখ করেছিলনিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঋণ বাদ দিয়ে গত ডিসেম্বরের ভিত্তিতে ব্যাংকটিতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৩৩ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা
সামগ্রিকভাবে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছেমাত্র এক বছরের ব্যবধানেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাত হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা২০১১ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ছিল পাঁচ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা
বিপুল অঙ্কের এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে আগের হিসাবে ধরলে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির দরকার সাত হাজার ১৮০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যাংক সংরক্ষণ করেছিল চার হাজার ৪২ কোটি টাকাঅর্থা, ঘাটতি ছিল তিন হাজার ১৩৮ কোটি টাকাবাংলাদেশ ব্যাংক নতুনভাবে ঋণখেলাপি চিহ্নিত করায় এখন ঘাটতি বেড়ে হচ্ছে চার হাজার ২৭৮ কোটি টাকা
সোনালী ব্যাংকের এই বেহাল অবস্থা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়েছেবাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকে ব্যাংকটির পরিস্থিতি গুরুতর বলে উল্লেখ করেনগত বুধবার বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ব্যাংকের হিসাব এখনই চূড়ান্ত না করতে পরামর্শ দিয়েছেতিনি জানান, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুণমান বিবেচনায় ৮০০ থেকে হাজার কোটি টাকার ঋণকে খেলাপি চিহ্নিত করেছে বলে জানিয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে এখনো আমরা প্রতিবেদন পাইনিপুরোপুরি তথ্য ৩০ মার্চের মধ্যে আমাদের কাছে আসবেসে পর্যন্ত আমরা হিসাব চূড়ান্ত করতে পারছি না
মূলধনের ঘাটতি: সূত্র জানায়, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ এক হাজার ৯০৪ টাকা উল্লেখ করা হয়বলা হয়, সরকারের দিক থেকে ব্যাংকটিতে প্রয়োজনীয় মূলধনের জোগান দেওয়া আবশ্যক
তবে শুধু সোনালী ব্যাংক নয়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ক্ষেত্রেও মূলধন ঘাটতির পরিমাণ প্রকৃতপক্ষে আরও বেশিবিগত জোট সরকার আমলে ২০০৪ ও ২০০৫ সালের বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাংকের শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও ব্যাংক আধুনিকীকরণ প্রকল্পের (এন্টারপ্রাইজ গ্রোথ ও ব্যাংক মর্ডানাইজেশন প্রোজেক্টইজিবিএমপি) আওতায় এই ব্যাংকগুলোতে তিন বছরের জন্য ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকিং কার্যক্রম উন্নতিতে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়তাদের পরামর্শ ছিল, এগুলোকে কোম্পানিতে রূপান্তর করতে হবেকোম্পানিতে রূপান্তরের পর্বে ব্যাংকগুলোর সমন্বিত লোকসানকে সম্পদে পরিণত করা হয়সে সময় ব্যাংকগুলোর সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা শাখা ও ব্যবসাকে গুড উইলবা সুনাম বিবেচনা করা হয়হিসাববিজ্ঞানে সুনামকে সম্পদ খাতে দেখানো হয়ব্যাংকগুলোতে এই সুনামকে লোকসানের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছিল
কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ নিয়ে আপত্তি করেছেসংস্থাটির কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ নিচ্ছে সরকারএই ঋণের শর্ত মেনে এখন সমন্বিত লোকসানকে মুনাফা থেকে সমন্বয় করা হচ্ছেইতিমধ্যে কিছু সমন্বয়ের পর এখনো প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার লোকসান রয়েছে সোনালী ব্যাংকেএর সঙ্গে এক হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঘাটতি যোগ করলে মূলধন ঘাটতি সাড়ে চার হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকবে
মুনাফা পরিস্থিতি: ২০১১ সালে সোনালী ব্যাংক ৫৩৪ কোটি টাকার নিট মুনাফা করেছিলআর ২০১২ সাল শেষে ব্যাংকটির নিট লোকসান এক হাজার ২৭৮ কোটি টাকাব্যাংকটির ১২ শাখায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক খেলাপি ঋণের আবিষ্কার যোগ করলে লোকসানের পরিমাণ হবে দুই হাজার ৪১৮ কোটি টাকা
ব্যাংকটির রূপসী বাংলা শাখা থেকেই হল-মার্ক গ্রুপসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠান তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা জালিয়াতি করে বের করে নিয়েছেআত্মসা করা এই বিপুল অর্থের প্রায় পুরোটাই এখন খেলাপি হয়েছেতাই এর বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়েছে কারণে পুরো ব্যাংকটিই বড় লোকসানের মধ্যে পড়েছেহল-মার্ক কেলেঙ্কারির প্রভাবে অন্য ব্যাংকেরও ব্যবসা কমেছে
হল-মার্ক ও রূপসী বাংলার দায়: সোনালী ব্যাংক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রূপসী বাংলা শাখায় জালিয়াতির জন্য ব্যাংকটির নিট দায়ের একটি হিসাব দিয়েছেএতে দেখা যাচ্ছে, হল-মার্কের নিট দায় দুই হাজার ৬৮১ কোটি ৪৮ লাখ টাকাআর টি অ্যান্ড ব্রাদার্স গ্রুপ, প্যারাগন নিট, নকশী নিট, ডিএন স্পোর্টস ও খান জাহান আলী সুয়েটারসের কারণে নিট দায় হয়েছে ৯২১ কোটি চার লাখ টাকা
সূত্র জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি বলেন, হল-মার্ক কেলেঙ্কারির অর্থ কোনোভাবেই আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেইনামমাত্র জামানত রয়েছে এই বিপুল জালিয়াতির বিপরীতেফলে সরকারের উচিত হবে সোনালী ব্যাংকের পরিস্থিতি বিবেচনা করে মূলধনের জোগান দেওয়া
সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মুহূর্তে ব্যাংকটিতে মূলধন জোগান দিতে সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেসংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছেও বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে সরকারকে এগিয়ে আসার সুপারিশ করেছে

২০ মার্চ/২০১৩/নিউজরুম.

শেয়ার করুন