চট্টগ্রাম: ‘আরামের ঘুম’ হারিয়ে গেছে জীবন নামের অভিধান থেকে। ঘুমাতে যাওয়ার সময় নির্দিষ্ট নেই। কিন্তু জাগতে হয় রাত তিনটা-সাড়ে তিনটার মধ্যে। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে সারতে হয় প্রাকৃতিক কাজ ও প্রাত:রাশ। এরপর ছুটতে হয় কর্তব্য পালনে।
রাত চারটা-সাড়ে চারটার মধ্যেই উপস্থিত হতে হয় নির্ধারিত স্থানে। সারাদিনই রাস্তায় দায়িত্ব-পালন। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া। সারা দিন কেটে যায় রাস্তায় রাস্তায়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পাল্টে গেছে পুলিশের দৈনন্দিন দায়িত্ব পালনের চিত্র। আর পুলিশ কনস্টেবল নূরে আলমরা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অস্থিতিশীল চিত্রের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। ভেবেছেন এটা তাদের কর্তব্য, এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই।
দেশের পরিস্থিতি শান্ত-স্বাভাবিক ও জানমাল রক্ষায় সারাদিন টানা দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের। ক্লান্তি-বিশ্রাম এসব শব্দ যেন তাদের অভিধানে নেই। সেখানে শুধু আছে পরিশ্রম। ভোর থেকে রাত, পালন করতে হয় একের পর এক দায়িত্ব। ছুটতে হয় নগরীর এখান থেকে ওখানে।
প্রতিদিন নিয়ম করে সূর্য পশ্চিমাকাশে অস্ত যায়। প্রকৃতির বুকে সন্ধ্যা নামে। ঘরে ফিরতে শুরু করে কর্মজীবী মানুষ। আর নগরবাসীর নিরাপত্তায় তখনো নগরের বিভিন্ন মোড়ে দায়িত্ব পালন করতে থাকে পুলিশ সদস্যরা।
আক্ষেপ নিয়ে নূরে আলম বলেন, ‘সন্ধ্যার পর যখন সবাই পরিবারের কাছে ফেরে তখন আমরা অপেক্ষায় থাকি নির্দেশনার। কোনো সময় সে নির্দেশনা আসে কোন এলাকার অশান্ত পরিস্থিতি শান্ত করতে ছুটে যাওয়ার জন্য। আবার কখনো নির্দেশ আসে ব্যারাকে ফেরার। তখন একটু বিশ্রাম মেলে।’
সোমবার দুপুরে নগরীর কাজীর দেউরি এলাকায় মহানগর বিএনপির কার্যালয়ের সামনে কথা হয় কনস্টেবল নূরে আলমের সঙ্গে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় হরতালে দায়িত্ব পালনের চিত্র কিভাবে পাল্টে যায় তা জানান বাংলানিউজকে।
সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে রাতের কোনো এক সময় নূরে আলমরা ব্যারাকে ফেরে। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমাতে গিয়ে দেখা যায় ঘড়ির কাটা হয়ত পাড়ি দিয়েছে ১২টার ঘর।
নাম প্রকাশ না করে আরেক কনস্টেবল বলেন, ‘মুঠোফোনে মা-বাবার সঙ্গে কথা হলেও বাড়িতে যাওয়া হয় না অনেক দিন। দেশের পরিস্থিতিও পাল্টে গেছে। তাই ইচ্ছা থাকা সত্বেও বাড়িতে যাওয়া এখন আর সম্ভব না। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এভাবে দিন কাটবে আমাদের।’
হরতালসহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে একই অবস্থা হয় তাদের উপরের স্তরের পুলিশ কর্মকর্তাদেরও। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে বহুগুণ। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পরিবার-পরিজনদের ঠিকমতো সময় দিতে না পারার চেহারায় যেমন আক্ষেপ আছে, তেমনি রয়েছে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ছাপ।
কোতয়ালি থানার এক পুলিশ উপ-পরিদর্শক বলেন, “হরতালের আগের দিনই শুরু হয়ে যায় ‘ডিউটি’। সারাদিন বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব পালন শেষে রাতে ফিরতে হয় থানায়। সেখানে মামলাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়। এসব করতে করতে কখন যে রাত দুইটা-আড়াইটা বেজে যায়, তা টেরও পাওয়া যায় না। এরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ভোরের আগেই হরতালের দায়িত্ব পালন করতে ছুটে যেতে নির্ধারিত এলাকায়।”
নাম প্রকাশ না করে নগরীর এক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) বলেন,‘দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এতে আত্মীয়-স্বজন দূরে থাক অনেক সময় স্ত্রী-সন্তানকেও সময় দিতে পারিনা।’
তবে সবসময় উপরের বর্ণনার মত থাকে না দায়িত্ব পালনের এ চিত্র। নিরুত্তাপ হরতালে যখন উত্তাপ ছড়ায় তখন পাল্টে যায় দায়িত্ব পালনে সারাদিনের পুরো চিত্র। হরতাল সফল করার নামে রাষ্ট্রীয় ও সাধারণ মানুষের সম্পদ ধ্বংসে উন্মত্ত হয়ে উঠে হরতাল সমর্থকরা।
জানমাল রক্ষায় রাজপথে নেমে আসতে হয় পুলিশ সদস্যদের। দৃষ্কৃতিকারীদের বাধায় নিতে হয় কঠোর ভূমিকা। এতে অনেক সময় দুষ্কৃতিকারীরা সরাসরি হামলে পড়ে পুলিশ সদস্যদের ওপর। এতে থাকে প্রাণহাণির শঙ্কা। পাশাপাশি পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের উদ্বেগ তো আছেই।
তারপরেও সবকিছু উপেক্ষা করে দায়িত্ব পালন করতে হয় পুলিশ সদস্যদের।
মার্চ ১৮,২০১৩