ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের আইনজীবীকে ফের জরিমানা করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সোমবার নির্ধারিত এক ঘণ্টার যুক্তিতর্ক(আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন করতে ট্রাইব্যুনালে না আসায় গোলাম আযমের আইনজীবী ইমরান সিদ্দিকীকে ৫হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এর আগে গত ১৪ মার্চ গোলাম আযমের অন্য আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলামকে ১ হাজার টাকা জরিমানা করেন ট্রাইব্যুনাল। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে ট্রাইব্যুনালে হাজির না হওয়ায় তাকে জরিমানা করা হয়।
চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সোমবার দু’দিনে করা জরিমানার মোট ৬ হাজার টাকা অবিলম্বে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে তা ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারকে জানাতে বলেছেন। একই সঙ্গে বুধবার আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন পুনর্নির্ধারণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
সোমবার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে সিভিলিয়ান হয়েও সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি গোলাম আযমের ছিল বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে সে বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ও আসামিপক্ষে গোলাম আযমের আইনজীবী ইমরান সিদ্দিকীকে এক ঘণ্টা করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য রেখেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। সে অনুসারে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ প্রায় ৭০ মিনিট যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
কিন্তু গোলাম আযমের আইনজীবী ইমরান সিদ্দিকী ট্রাইব্যুনালে আসেননি। তার পক্ষে হরতালের কারণ দেখিয়ে গোলাম আযমের জুনিয়র আইনজীবী এস এম রায়হান উদ্দিন সময়ের আবেদন জানান। ট্রাইব্যুনাল ইমরান সিদ্দিকীকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে আসামিপক্ষের ৫ম দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য করেন।
এর আগে গত ১০ থেকে ১৪ মার্চ গোলাম আযমের পক্ষে ৪ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। অন্যদিকে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত ১০ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম ও প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ সীমন।
গোলাম আযমের মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া বর্তমানে শেষ ধাপে রয়েছে। আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করলে আইন অনুসারে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করবেন ট্রাইব্যুনাল।
উল্লেখ্য, নির্ধারিত ১২ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন সাফাই সাক্ষীকে হাজির করে সাক্ষ্য দেওয়াতে পেরেছেন আসামিপক্ষ। একমাত্র সাফাই সাক্ষী গোলাম আযমের ছেলে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী গত বছরের ১২ নভেম্বর থেকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাফাই সাক্ষ্য দেন তার বাবার পক্ষে। রাষ্ট্রপক্ষ তার জেরা শেষ করেন ১১ ফেব্রুয়ারি।
অন্যদিকে তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে জব্দ তালিকার ৭ সাক্ষীসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৭ জন সাক্ষী এর আগে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামিপক্ষ তাদের জেরাও সম্পন্ন করেছেন। তাদের মধ্যে ১ জন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া জবানবন্দিকেই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া ঘটনার সাক্ষীরা হলেন, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকারকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা দক্ষিণপাড়া গ্রামের সোনা মিয়া, একজন শহীদ পরিবারের নারী(ক্যামেরা ট্রায়াল), দেশবরেণ্য গীতিকার ও সুরকার মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, রাজধানীর নাখালপাড়ার ফরিদ আলম এবং মহসিন আলী খান।
আর জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেন- বাংলা একাডেমীর সহ গ্রন্থাগারিক মো. এজাব উদ্দিন মিয়া, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) রাজনৈতিক শাখার উচ্চমান সহকারী সেলিনা আফরোজ, কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের উচ্চমান সহকারী কাজী আইয়ুব হোসেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার কামালের বোন ডা. মুনিয়া ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় যাদুঘরের কিপার ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মরত সাঁট মুদ্রাক্ষরিক জামিনুর শেখ।
মানবতাবিরোধী ৫ ধরনের অপরাধের ৬১টি অভিযোগে অভিযুক্ত করে গত বছরের ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ১০ জুন তার বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। ১ জুলাই থেকে শুরু হয় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ হলো, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র, সহযোগিতা, উস্কানি, সম্পৃক্ততা ও বাধা না দেওয়া এবং ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতন। অভিযোগগুলোর মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত ৬টি, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা সংক্রান্ত ৩টি, উস্কানি দেওয়ার ২৮টি, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেওয়ার ২৩টি এবং নির্যাতন সংক্রান্ত ১টি অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়।
পরে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কারাগারে পাঠানোর পর চিকিৎসার জন্য তাকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার বিচার চলছে।
এর আগে গত বছরের ৯ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের জমা দেওয়া ওই আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মোট ৬২টি অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ৬১টি গ্রহণ করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। পরে কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের মাধ্যম। মোট ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র সংযুক্ত করা হয়।
মার্চ ১৮, ২০১৩