লাইফলাইনস—ফারাহ গজনভী
জুবান প্রকাশন
দাম: ৬৫০ টাকা
লাইফলাইনস সংকলনের যে দিকটি প্রথমে আমার ভালো লেগেছে, তা হলো নবীন লেখকদের এগিয়ে আসা। তাঁরা ভিন্ন ভাষার মাধ্যমে নিজেদের জগৎ তুলে ধরেছেন। কল্পনার বৈভবের সঙ্গে মিলিয়েছেন অভিজ্ঞতা, শিক্ষার আলো, চারপাশের মানুষ ও সাংস্কৃতিক চৈতন্য। তাঁরা দেশীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বের দরবারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান ইত্যাদি দেশের মেয়েরা ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করে নিজেদের একটি অবস্থান তৈরি করেছেন।অরুন্ধতী রায়, মঞ্জুশ্রী থাপা, কামিলা শামসি, কুনচান যোডেন প্রমুখ নিজেদের সাহিত্যের প্রকাশ ইংরেজি মাধ্যমে করায় বিদেশি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন। বাংলাদেশের প্রজন্মের মধ্যে তাহমিমা আনাম দেশের সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক মাত্রা দিয়েছেন। লাইফলাইনস ১৫ জন লেখককে হাজির করেছে প্রথমে সাউথ এশিয়ায়, পরে সীমান্ত অতিক্রম করে পৌঁছেছে অন্য দেশে। তাহমিমার উপন্যাসের পটভূমি মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের মানুষের জীবনের নানা অনুষঙ্গ। বলতে হয়, মনিকা আলীর কথা। তাঁর উপন্যাস ব্রিক লেন ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের গল্প প্রবাসী বাঙালির জীবনের গল্প।
যাঁরা ইংরেজিতে লিখছেন, তাঁদের লেখার পটভূমিতেও নিজের দেশ, মানুষ, সংস্কৃতি, ব্যক্তির সমস্যা-সংকট, আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-ভালোবাসা। বিদেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় একটি জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের গল্প। পাশাপাশি আছে বিশ্বের অন্য দেশের মানুষের সঙ্গে লেখকদের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা। লাইফলাইনস এর নবীন লেখকেরা এভাবেই নিজেদের সাহিত্যকে উপস্থাপন করেছেন। তাঁদের গল্পের অনেকখানি জুড়ে আছে বাংলাদেশের নারীদের সমস্যা। তাঁদের কেউ কেউ বিদেশে বসে লিখেছেন, কেউ দেশে বসে। তাঁরা সবাই কমবেশি নারীদের সমস্যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন।
গল্প লিখেছেন শবনম নাদিয়া, সাবরিনা ফাতেমা আহমদ, শ্রাবন্তী শারমীন আলী, শর্বরী আহমেদ, ফারাহ গজনভী, আবীর হক, তিসা মুহাদ্দেস, এস. বারি, মুনিজে মনজুর, লরি এস. খান, সাজিয়া ওমর, ইফফাত নওয়াজ, রুবাইয়াত খান, সাদাফ সাজ. সিদ্দিকী, অলিজে আহমেদ।
শুরুর গল্পটি লিখেছেন শবনম নাদিয়া। গল্পের নাম টিচার শর্টেজ. শেষ গল্পটি লিখেছেন আলিজে আহমেদ। গল্পের নাম বি| এই গল্পে আলিজে দৃঢ়তার সঙ্গে গল্পের থিম ধরেছেন। ছোট এই গল্প অত্যন্ত তীব্র। আকারে আর ছোট থাকেনি। পরিসর বাড়িয়েছে থিমের। এ গল্পের দেশ নেই। এটি বিশ্বের যেকোনো দেশের বিষয়।
শবনম নাদিয়া পারিবারিক বিরোধের গল্প লিখেছেন। ঘরের ভেতর ঘটে যাওয়া ঘটনা মেয়েশিশুদের কীভাবে প্রভাবিত করে তার কথা। একই সঙ্গে একধরনের দুঃখবোধ তাদের ওপর চাপানো থাকে।পুতুল-মিতুল-পামেলাসহ অনেক মেয়েশিশুর এভাবে জীবন দেখার অভিজ্ঞতা হয়।
শর্বরী আহমদের গল্পের নাম ‘পেপসি’। এই গল্পের স্থান আদ্দিস আবাবা। ১০ বছর বয়সী জারা বাবা-মায়ের চাকরিসূত্রে এ দেশে এসেছে। বয়সের তুলনায় তার ভাবনার জায়গা অনেক পোক্ত। সে ফিলিস্তিনের সমস্যা বোঝে, ইথিওপিয়া আফ্রিকার একমাত্র দেশ; যেটি কখনো উপনিবেশ হয়নি, এটিও জানে। দুর্ভিক্ষ বোঝে।বিদেশিরা ওর মায়ের শাড়িকে স্কার্ফ বললে ওদের ভুল ভাঙিয়ে দেয়। বাড়িতে একা থাকার অভিজ্ঞতায় পীড়িত হয়। একসময় স্থানীয় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে একদিন দেখতে পায় ওদের বাড়িঘরে পুলিশের হামলা।
সাদিয়া সাফ নাজের গল্পের নাম ডে ড্রিমস নারীর সংগ্রামের গল্প। প্রেম থেকে অবৈধ সন্তান—সেই সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার গল্প। সহযোগিতা দিয়েছে গ্রামের নারীদের সংগঠন ‘শক্তি’। নারীর সংগ্রামের মধ্যে আশাবাদী ভবিষ্যতের কথা বলেছেন। শেষ করেছেন এভাবে She smiled inside, Closed her eyes, and as she listened to the imam’s munajat blessing them, she started to daydream. এত কিছুর পরও নারীর স্বপ্ন দিবাস্বপ্নই হয়ে যায়। সমাজ বাস্তবতায় এভাবে ফুটছে নবীনদের লেখায়। ফারাহর নিজের গল্পের নাম গেটিং দেয়ার, এই গল্পের পটভূমি নাগরিক জীবন। এখানেও নারীর প্রতিরোধের ভূমিকা আছে। গল্পের নায়িকা বলছে, Don’t worry sweetheart. It won’t take much longer I promise, we are getting there. দুটো গল্পের মধ্যে বাংলাদেশের গ্রাম এবং নগরজীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে সুন্দরভাবে।
সাজিয়া ওমরের টেবিল ফর থ্রি, ইফফাত নেওয়াজের গান্দারিয়া, আবীর হকের ওয়াক্স ডল, শ্রাবন্তী নারমীন আলীর ইয়েলো ক্যাব, সাবরীনা ফাতেমা আহমদের সামথিং ফিশি, তিসা মুহাদ্দেসের ওভার অ্যান্ড অ্যাগেইন, মুনিজে মনজুরের বুকএন্ডস, লরি এস. খানের মেহেন্দি ড্রিমস , রুবাইয়াত খানের রিদা, এস. বারির টাচ মি নট গল্পের মধ্যে জেন্ডার ইস্যু নানা মাত্রায় এসেছে। ভাষার সর্বজনীন মাত্রা নিয়ে এই নবীন লেখকেরা বিষয়গুলোও এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতের ভিন্নতা সত্ত্বেও গল্পের থিম অন্য দেশের সীমানায় ঢুকতে পারে।
এখানেই এই বইটির গুরুত্ব। সাহিত্যশিল্পের সঙ্গে যুক্ত করেছে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা।
একদিন এই সংকলনের প্রত্যেক লেখকের নিজেদের একক বই হবে এই আশাবাদ রেখে লেখকদের অভিনন্দন। প্রত্যেকের একক বইয়ের মানসম্মত সংখ্যায় গড়ে উঠবে ইংরেজি ভাষায় রচিত সাহিত্য।
সম্পাদককে অভিনন্দন একটি সুসম্পাদিত সংকলনের জন্য।
১৮ মার্চ/২০১৩/নিউজরুম.