শেখ হাসান আল নাসেরি ইরাকের এমন এক উপজাতির প্রধান, যার শিকড়ের উৎস দেশটির অটোমান সাম্রাজ্যের আমলে। এমন একটি উপজাতির নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য কয়জনের হয়? তবে নাসেরির আসলে কপাল খারাপ। কারণ, যে সময়ে তিনি এই পদে, সেটা তাঁর বংশের জন্য সবচেয়ে উত্তাল সময়গুলোর একটা।
নাসেরির উপজাতিটির সবচেয়ে ‘কুখ্যাত’ সন্তান সাদ্দাম হোসেনের তিন দশকের শাসনামলে শেখ হাসান ও ইরাকের ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’র অন্য সদস্যরা তাঁদের নিজ শহর তিকরিতে অতুলনীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। রাজধানী বাগদাদ থেকে উত্তরের সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ যে শহর একদা ছিল দারিদ্র্যে জর্জরিত, সেই শহরই হয়ে ওঠে প্রাচুর্যের প্রতীক।সারি সারি সুউচ্চ ভবনে তিকরিত হয়ে ওঠে জমকালো এক শহর। আর এখান থেকে বাগদাদে যাওয়ার পথে কেবল নাসেরি নামটা উচ্চারণ করাটাই সবক্ষেত্রে উন্নত সেবা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল; কি বা দোকানে কি বা রেস্তোরাঁয়। আর পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে ভালো বেতনের চাকরি তো আছেই।
তার পর সবই শেষ হয়ে যায় আচমকা এক ঝড়ে। সাদ্দামকে উৎখাতে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ মধ্য রাত থেকে শুরু হয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিমান হামলা। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তিকরিতে বাথ পার্টির প্রকাণ্ড ভবনটি চোখের পলকে গুঁড়িয়ে যায়; সাদ্দামের অভিজাত রিপাবলিকান গার্ড মিশে যায় মাটির সঙ্গে। বলতে গেলে কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই পতন ঘটে তিকরিতের। সেই ঘটনার ১০ বছর পার হবে আসছে ২০ মার্চ। আজ নাসেরির উপজাতির সব ধরনের আশীর্বাদই পরিণত হয়েছে অভিশাপে। তিকরিত শহরের অদূরে অবস্থিত আল-ওজা গ্রামে তাঁদের পূর্বপুরুষের সব সম্পদ মার্কিন বাহিনীর নির্দেশে জব্দ রয়েছে। আর ৬২ বছর বয়সী শেখ হাসান—যিনি তাঁর সাত হাজার সদস্যের উপজাতীয় বাহিনীর হাতে ২০০৩-১১ মেয়াদে বহু মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার ঘটনায় গর্বিত—এখন অভিযোগ তুলছেন, তাঁরা নিয়মিতই শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
শেখ হাসান আল-ওজা গ্রামে তাঁদের বৈঠকখানায় বসে দ্য টেলিগ্রাফ-এর এই প্রতিবেদককে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বলেন, ‘সব সময়ই আমাদের প্রায় ৫০ জন জেলে থাকছে।…এই যে আমরা কথা বলছি, এখনো আমাদের উপজাতির কাউকে নির্যাতন করা হচ্ছে।’
সাদ্দামও সমানভাবে ‘নিষ্ঠুর ও ন্যায়বিরুদ্ধ’ ছিলেন বলে স্বীকার করেন শেখ হাসান। তবে ২০০৬ সালে বাগদাদে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর সাদ্দামের লাশ যখন তিকরিতে আনা হয়েছিল, তখন চিৎকার করে কেঁদেছিলেন তিনি। শেখ হাসান এই প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেন, ‘ধরুন, ফ্রান্স আপনার যুক্তরাজ্যে আক্রমণ করল এবং রানিকে হত্যা করল, তখন আপনার অনূভূতিটা কেমন হবে?’ তাঁর বক্তব্য, সাদ্দাম তাঁদের জন্য অন্তত উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিধান করেছিলেন। ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা বলেছিল, সাদ্দামের পতনের পর তারা দেশের উন্নতি ঘটাবে। কিন্তু ১০ বছরেও আজ দেশে চরম অরাজকতা অব্যাহত রয়েছে।
বাস্তবেই সাদ্দামের পতনের পর দেশ পুনর্গঠনের কাজটা দিনকে দিন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িকতা দেশটিতে গেড়ে বসেছে। এসব সমস্যা এখন কেবল শেখ হাসানের মতো সাদ্দামের শাসনামলের সুবিধাভোগীরাই নন, দেশের সব নাগরিককেই কুরে কুরে খাচ্ছে। দ্য টেলিগ্রাফ।
১৮ মার্চ/২০১৩/নিউজরুম.