স্পোর্টস ডেস্ক বোলিং করতে এসে থেমে গেলেন এক অফ স্পিনার। শর্ট মিড উইকেটে দাঁড়ানো বিশাল বপু লোকটা ডান হাত বাড়িয়ে কোন ফিল্ডারকে যেন আরেকটু বাঁয়ে সরতে বলছেন।বোলার বল করলেন। ব্যাটসম্যান লেগ গ্লান্স করলেন, ফাইন লেগে দাঁড়ানো ফিল্ডার দৌড়ে এসে বল ধরে ফেরত পাঠালেন উইকেটকিপারের গ্লাভসে।
বোলারের নাম অরবিন্দ ডি সিলভা। ফিল্ডার মুত্তিয়া মুরালিধরন। উইকেটকিপারের নাম রুমেশ কালুভিতারানা। ওই বিশাল বপু যে লোকটার কথা বলা হয়েছে, তাঁকে বোধ হয় এরই মধ্যে চিনে ফেলেছেন। অর্জুনা রানাতুঙ্গা।
১৯৯৬ বিশ্বকাপের স্মৃতিও কি ফিরে এল আপনার মনে? কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠের দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যায় সেই সুখস্মৃতিই তো উড়ে বেড়াল কাল।ব্যাটসম্যানরা মাঠে যাচ্ছেন, তাঁকে শ্রীলঙ্কান পতাকার ছায়ায় ঢেকে মাঠে এগিয়ে দিচ্ছেন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত সমর্থক পার্সি আবেসেকেরা। ব্যাটসম্যান আউট হয়ে ফিরছেন, তাঁকে ফিরিয়ে আনতে ঢুকে যাচ্ছেন মাঠে। মিউজিক বাজছে আর চলছে স্মৃতিচারণা—লাহোরের ওই রাতে আমি ওখানে খেলা দেখছিলাম, শ্রীলঙ্কা জেতার পর আমি এই করেছিলাম…।
পার্সি আবেসেকেরা টেস্ট ম্যাচের শেষ ঘণ্টার খেলা ফেলে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের মহানায়কদের দেখতে আসা বাংলাদেশের সাংবাদিককে বলছেন, ‘ঠিক কাজ করেছ।প্রেমাদাসায় কজন দর্শক আছে আর এখানে দেখো কত! এঁরা হলো কিংবদন্তি। এঁদের কারণেই তো ওখানে সাঙ্গাকারারা এমন খেলতে পারছে।’
শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জয়ের ১৭তম বার্ষিকীতে আবারও তাঁর দল নিয়ে মাঠে অর্জুনা রানাতুঙ্গা। শরীরটা আগেও দশাসই ছিল, এখন প্রস্থে আরও বেড়েছে। অরবিন্দ ডি সিলভা ও হাশান তিলকরত্নে বেশ ভালো একটা ভুঁড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। দুই পেস বোলার রবীন্দ্র পুষ্পকুমারা ও প্রমোদ্য বিক্রমাসিংহে ফুলেফেঁপে উঠেছেন এই ১৭ বছরে। শুধু কালুভিতারানা আর উপুল চন্দনাই দেখা গেল সেই আগের শরীরটাই ধরে রাখতে পেরেছেন।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ দলের সবাই অবশ্য ছিলেন না। সনাৎ জয়াসুরিয়ার হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হয়েছে কিছুদিন আগে। ম্যাচের আগে গ্রুপ ছবিতে থাকলেও খেললেন না।চামিন্ডা ভাস ও মারভান আতাপাত্তু শ্রীলঙ্কা দলের সঙ্গে প্রেমাদাসায়। ম্যাচ রেফারির কাজে রোশান মহানামা শ্রীলঙ্কার বাইরে। আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনাও তা-ই। অশাঙ্ক গুরুসিনহা অনেক বছর ধরেই মেলবোর্নে বসত গেড়েছেন। দুই মাস আগে এমনই একটা ম্যাচে এসে খেলে গেছেন। এবার পারলেন না। বিশ্বকাপজয়ী দলের একাদশ গড়তে তাই কদিন আগে বিশ্বকাপে চমক জাগিয়ে আসা শ্রীলঙ্কা মহিলা ক্রিকেট দলের দুজনকে নিতে হলো।
প্রতিপক্ষ সিদাথ ওয়েতিমুনির নেতৃত্বে সাবেক ক্রিকেটাররা। বিশ্বকাপ জয়ের বার্ষিকী উদ্যাপনের চেয়েও অনেক বড় এক উদ্দেশ্য ছিল দুপুর দুটো থেকে শুরু হওয়া এই টি-টোয়েন্টি ম্যাচের। সাবেক শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার ও প্রধান নির্বাচক গাই ডি অলউইস স্ত্রী ও দুই কন্যাকে রেখে ক্যানসারের কাছে হার মেনেছেন দুই মাস আগে। তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়াতেই এই চ্যারিটি ম্যাচ, যেটির উদ্যোক্তা অর্জুনা রানাতুঙ্গা।
‘আপনি না টি-টোয়েন্টির এত বিরোধী, অথচ টি-টোয়েন্টিই যে খেললেন’—ম্যাচ শেষে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময় কথাটা শুনে রানাতুঙ্গা হাসলেন, ‘৫০ ওভারের ম্যাচই খেলার কথা ছিল। সবাই বলল, এই বয়সে শরীরে এত ধকল সইবে না।’ ম্যাচ আয়োজনের উদ্দেশ্যটাও বললেন সবিস্তারে, ‘গাই ডি অলউইস আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল।শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটে ওর অনেক অবদান। ওই যুগে ক্রিকেটাররা শুধুই খেলাটা ভালোবেসে খেলে গেছে। টাকাপয়সার কথা ভাবেনি। তাদের পাশে দাঁড়ানোটা তাই আমাদের কর্তব্য।’
বিশ্বকাপজয়ী তাঁর দলকে রানাতুঙ্গা বলেন, ‘নাইনটি সিক্স বয়েজ’। মহৎ কোনো উদ্দেশ্যে ডাক দিলেই সেই ‘বয়েজ’রা সাড়া দেয় বলে গর্ব করলেন। মাস দুয়েক আগে এমনই একটা ম্যাচ খেলেছেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষায় ব্যয় করার জন্য টাকা তুলতে। আধুনিক ক্রিকেটকে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়লেন না, ‘এখন তো সবকিছুতেই বাণিজ্য। চ্যারিটি ম্যাচ খেলতেও ক্রিকেটাররা টাকা চেয়ে বসে।’
সেই ‘নাইনটি সিক্স বয়েজ’দের সঙ্গে মাঠে নামলে স্মৃতি তোলপাড় তোলে না মনে? রানাতুঙ্গার চোখে স্মৃতির মেদুরতা, ‘এমনিতে অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ তো হয়ই। কিন্তু একসঙ্গে খেলাটা একটা অন্য রকম ভালো লাগা।’ সেই ভালো লাগায় আক্রান্ত ব্যাটে-বলে ১৯৯৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের নায়ক অরবিন্দ ডি সিলভাও।মাঝখানে নির্বাচক হিসেবে কাজ করেছেন। এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। কথাবার্তায় বরাবরই ব্যাটিংয়ের বিপরীত। বিশ্বকাপের কোন স্মৃতিটা বেশি মনে পড়ে প্রশ্নটা শুনে যেন একটু অবাকই হলেন, ‘কাপ জেতাটা। আর কি মনে পড়বে?’ মুত্তিয়া মুরালিধরনেরও একই উত্তর।
বিশ্বকাপ জয়ের সুদূরপ্রসারী প্রভাবটা অবশ্য সবিস্তারেই বললেন দুজন।অরবিন্দের চোখে ওই বিশ্বকাপ জয়ই শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটকে এত দূর এনেছে, ‘১৯৯৬-এর কারণেই ক্রিকেট শ্রীলঙ্কার এক নম্বর খেলা হয়েছে। কিশোর-তরুণেরা আরও বেশি করে ক্রিকেটে এসেছে।’
মুরালিধরন এর পরও আরও অনেক বছর খেলে গেছেন বলে বিশ্বকাপ জয়ের মাহাত্ম্যটা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারলেন, ‘ওটাই শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের মনে বিশ্বাসটা এনে দিয়েছিল যে আমরাও জিততে পারি। এখনকার ক্রিকেটাররা আজকের জায়গায় আসতে পেরেছে এ কারণেই।’
হাশান তিলকরত্নে সেই সাফল্যে অর্জুনা রানাতুঙ্গার ভূমিকার কথাটা মনে করিয়ে দিলেন। প্রিয় ‘আইয়া’ (মানে বড় ভাই) খেলোয়াড়দের কীভাবে আগলে রাখতেন, সেটি বলতে গিয়ে একটু আবেগাক্রান্তই হয়ে পড়লেন।
সন্ধ্যা হয়-হয়। এসএসসির ড্রেসিংরুমের পেছনে লাউঞ্জে খাওয়াদাওয়া আড্ডা চলছে।অর্জুনা রানাতুঙ্গার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন একেকজন। ‘চন্দনা স্পোর্টস’ নামে ক্রীড়াসামগ্রীর দোকান দেওয়া উপুল চন্দনা রানাতুঙ্গার হাত ছুঁয়ে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্কিপার।’
অর্জুনা রানাতুঙ্গা এখনো চন্দনাদের অধিনায়ক। অন্তত মার্চের এই ১৭ তারিখে তো বটেই!
(১৮ মার্চ): নিউজরুম