উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলায় এবার এক লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়নি। এতে প্রায় সাত লাখ টন ধান কম উৎপাদন হবে, যার দাম এক হাজার কোটি টাকারও বেশি।কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর এই ১০ জেলায় ছয় লাখ সাত হাজার ৮৪৫ হেক্টরে বোরোর আবাদ হয়েছিল। এবার আবাদ হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৫০ হেক্টরে। গত বছরের চেয়ে এর পরিমাণ এক লাখ সাত হাজার ১৯৫ হেক্টর কম। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বোরো আবাদে কৃষকের আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণে এবার আবাদের লক্ষ্যমাত্রাও গত বছরের চেয়ে ১৯ হাজার ২৯০ হেক্টর কম ধরা হয়েছিল। কিন্তু তা-ও পূরণ হয়নি। এবারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৮৭ হাজার ৯০০ হেক্টরে কম আবাদ হয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানায়, এবার যশোরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৫২ হাজার ১৩২ হেক্টর।আবাদ হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার ৫৮৫ হেক্টরে, ঝিনাইদহে ৮৩ হাজার ৬৩৬ হেক্টরের বদলে ৬৮ হাজার ৫৭০ হেক্টর, মাগুরায় ৪৩ হাজার ১৪৫ হেক্টরের বদলে ৩১ হাজার ৯০৫ হেক্টর, নড়াইলে ৪৩ হাজার ৪৭১ হেক্টরের বদলে ৩৫ হাজার ৮৯৫ হেক্টর, খুলনায় ৪৮ হাজার ৪৮২ হেক্টরের বদলে ৪৪ হাজার ৭০০ হেক্টর, বাগেরহাটে ৪৫ হাজার ২০৮ হেক্টরের বদলে ৪৩ হাজার ৮৬৫ হেক্টর, সাতক্ষীরায় ৭১ হাজার ৭২৯ হেক্টরের বদলে ৬৬ হাজার ২৭০ হেক্টর, কুষ্টিয়ায় ৩১ হাজার ২৮৯ হেক্টরের বদলে ২৭ হাজার ৩৯০ হেক্টর, চুয়াডাঙ্গায় ৩৯ হাজার ৩০৬ হেক্টরের বদলে ৩২ হাজার ৫০০ হেক্টর এবং মেহেরপুরে ২৫ হাজার ১৫৭ হেক্টরের বদলে আট হাজার ৮০৫ হেক্টরে আবাদ হয়েছে।
কৃষকেরা জানিয়েছেন, এক বিঘায় সাধারণত ২০-২১ মণ করে বোরো ধান উৎপাদন হয়। কৃষি বিভাগের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও তাই। এ হিসেবে এবার এক লাখ সাত হাজার ১৯৫ হেক্টরে বোরোর আবাদ না হওয়ায় ছয় লাখ ৮১ হাজার ৭৫০ টন ধান কম উৎপাদন হবে। বর্তমান বাজার মূল্য টনপ্রতি ২০ হাজার টাকা হিসাবে তার দাম এক হাজার ৩০০ কোটি টাকারও বেশি।
কৃষকেরা জানিয়েছেন, এবার বোরোর আবাদে বিঘাপ্রতি পাঁচ-ছয় হাজার টাকা লোকসান হবে।ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি সাত টাকা বাড়িয়ে দেয়ায় এবার এক বিঘা বোরো আবাদে সেচ খরচ ধরা হয়েছে ছয় হাজার টাকা। গত বছর ডিজেলের দাম ছিল লিটারপ্রতি ৬২ টাকা। বিঘায় সেচ খরচ দিতে হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ার পাশাপাশি মজুর ও চাষ খরচসহ সব কিছুর দাম বেড়েছে। আগে এক বিঘা জমি রোপণের কাজে মজুর খরচ ছিল এক হাজার টাকা। এবার দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা।চাষ খরচও বেড়ে ৭০০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ক্ষেত পরিচর্যা, সার, কীটনাশক, ফসল কাটা, মাড়াই প্রভৃতি অত্যাবশ্যকীয় খরচ। সব মিলিয়ে এবার এক বিঘা বোরো চাষে খরচ পড়বে ১৫ হাজার টাকার ওপরে।অথচ যে ধান উৎপাদন হবে তার দাম ১০ হাজার টাকার বেশি হবে না। এ কারণে অনেকেই ধানচাষ বাদ দিয়ে অন্য ফসল চাষের প্রতি ঝুঁকেছেন।
শার্শা উপজেলার খাসখালী গ্রামের কৃষক আজগার আলী জানান, তিনি খরচ হিসাব করে লোকসান বোঝে ধানের বদলে তিলের আবাদ করেছেন। যশোর সদর উপজেলার নারাঙ্গালী গ্রামের আবদুর রাজ্জাক প্রতি বছর চার-পাঁচ বিঘা করে বোরোর আবাদ করেন। এবার এক বিঘাও আবাদ করেননি।
কৃষকেরা অভিযোগ করেছেন, সেচ খরচ বাবদ সরকার প্রতি বছর কিছু ভর্তুকি দেয়। কিন্তু এ টাকা কোনো কৃষক পান না। সেচ মেশিন মালিকেরা ভর্তুকির সুফল ভোগ করেন। উৎপাদনকারী কৃষকেরা এর কিছু অংশ পেলে তারা সামান্য হলেও আর্থিক সাশ্রয় পেতেন। ঝিকরগাছা উপজেলার নওদাপাড়া গ্রামের কৃষক ওসমান গনি জানান, ভর্তুকির টাকা কৃষকের দিলে তারা অন্তত বিঘায় ৫০০ টাকা সাশ্রয় পেতেন।
কৃষি বিভাগ ধানের দর পতনের কারণে বোরো চাষে কৃষকের অনীহার কথা স্বীকার করে জানিয়েছে, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে উৎপাদনকারীদের স্বার্থের দিকে নজর দিতে হবে।
১৭ মার্চ, ২০১৩