নগর ও নাগরিক বাস্তবতা কোনো সহজ পাঠ্যবিষয় নয়। আধুনিক সমাজে নগরকেন্দ্রিকতার মধ্যে ব্যক্তি হামেশাই হারিয়ে যায়। কারণ, তার ঐকিক বাস্তবতা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এমন আচ্ছন্নতা থেকেই নাগরিক একাকিত্ববোধ ও একাকিত্ববাদের সূত্রপাত। খণ্ড খণ্ড যে ব্যক্তিবর্গ, তাদের দৃষ্টিতে বাস্তবতাও অথৈবচ, এমন খণ্ডতার প্রতিচ্ছবির মধ্য দিয়েই শিল্পী ও কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য্য বাস্তবের একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে চান। দাগ-তামাশা প্রদর্শনী তারই প্রতিনিধিত্ব করেছে।
শিশিরের চিত্রভাষা বাস্তবের সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি করে, তা দেশীয় আভাগার্দের প্রপঞ্চের মধ্যে প্রোথিত। জাতীয় রাজনীতি, সমাজ ও বাস্তবতা তাঁর বিচরণের ক্ষেত্র; এ-বিষয়ক ভাষ্য তৈরির প্রক্রিয়ায় তিনি জার্মান দাদাবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে বর্তমান তিনি তাঁর সচেতন ও সমালোচনামূলক দৃষ্টি দিয়ে উদ্ঘাটন করেন, তা দুই মেরুজাত। এক. শিল্পীসমাজের অসামঞ্জস্যতা ও গত চার দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবনমনের দিকটি চাক্ষুষ করে তোলেন; দুই. তিনি তাঁর উদ্দেশ্য সাধনে সরল-সহজ নন্দনতাত্ত্বিক কৌশল ব্যবহার করে উপস্থাপিত বিষয়গুলোর জটিল সম্পর্কে আলো ফেলেন।
এই দুইয়ের মিশ্রণে যে তৃতীয়ের জন্ম, তা শিল্প।শিশিরের এই শিল্প শিল্পের অঙ্গনে প্রচলিত ভাষার প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রথম হাজির হয় আশির দশকের শুরুতে। ‘সময়’ শিল্পীদের একজন হিসেবে সাদাকালোর ফুটিয়ে তোলা সামাজিক অবক্ষয়ের লাগসই চিত্রগুলো তখন সবার নজর কাড়ে।আলোছায়ার নাটকীয়তা এ সময়ের চিত্রকল্পের সমাজ সমালোচনার মাত্রাকে ধারালো করে তুলতে সাহায্য করে। জাতীয়তা ও জাতীয় চৈতন্য এবং বাস্তবতার ফারাক নির্ধারণে এ পর্যায়ে শিল্পী সবচেয়ে জুতসই কিছু প্রতীকের উদ্বোধন করেন, যেমন শাপলা ভক্ষণরত পুরুষ, আর্মি জেনারেলের পোশাক, কিংবা স্যুট-টাই পরিহিত আমলা। জার্মান শিল্পী গেয়র্গ প্রশ্নের আদলে শিশির ভট্টাচার্য্য বুর্জোয়া সমাজের অবক্ষয় তুলে ধরতে যৌন অবক্ষয়ের নিমিত্তে তৈরি কিছু প্রতীক বা চিত্রজ-মডেল তৈরি করতেন। এসব মডেল তাঁর চিত্রকল্পের সাংঘর্ষিক ভাষাকে তির্যক করে তুলতে সাহায্য করেছে।
সমালোচকের তির্যক দৃষ্টিই আসলে স্বতঃস্ফূর্ততার পরিসর। সচেতন সমালোচনামূলক অবলোকন যখন তির্যক প্রক্ষেপণের সূত্রে নতুন আদল পায়, তখন চিত্রভাষা খর ও শ্লেষ্মাত্মক হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। এই খরতা শিশিরকে অনেক ‘বিদগ্ধ’ শিল্পরসিকের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে, কিন্তু ইতিহাসে, বিশেষ করে শিল্পকলার ইতিহাসে শিল্পীর এমন বিপ্রতীপ কথনভঙ্গির স্থান সুনির্দিষ্টভাবেই ওপরের সারিতে।
দৃষ্টিনন্দন না হয়ে শিশির যে ভাষা গড়লেন, তা বাহ্যিক ও অন্তরালে লুকানো বাস্তবতার ব্যত্যয়ের আলামত হাজির করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রথম পর্যায়ের কাজে এসব উপসর্গ একত্রে চিত্রের জগতে এক অভিনব আলোছায়ার কৌশল মারফত উপস্থাপিত।অধুনা সেই নাটকীয়তার বদলে রেখার সহজ প্রকাশ লক্ষণীয়। রঙে ফিরে এসে তিনি যে বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকা-ভিলেন—এই তিনের মধ্যে সমাজ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিত তৈরিতে ব্রতী হলেন, এরই ধারাবাহিকতায় শিশির রেখাপ্রধান হয়ে উঠলেন।
বলা জরুরি যে রাজনৈতিক-সামাজিক ভাষ্য তৈরিতে কামরুল হাসান প্রথম জটিলতর, অর্থাৎ গতিশীল ও বহুমাত্রিক ব্যবহার ঘটান। আশির দশকের শুরুতে তাঁর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ক্যানভাস-চিত্রে এই ধারার বিকাশ লক্ষ করা যায়।অন্যদিকে, বাঙালি জাতীয়তার পক্ষে তিনি নানা প্রতীক বা চিত্র মডেল অনায়াসে ড্রয়িংয়ের সাবলীলতার সঙ্গে মেলাতে পেরেছিলেন। রেখার প্রতি এমনকি প্রতীক নির্মাণের প্রতি শিশিরের ঝোঁক কামরুলের অনবদ্য কিছু প্রতীকের সূত্রে পাঠ করা যেতে পারে। শিশিরের রেখা গতিহীন ধীর; প্রতীক নির্মাণের কামনায়ও কামরুলের ছায়া কল্পনা করে নেওয়া যায়। এতে শিল্পী হিসেবে শিশিরের স্বকীয়তা অস্বীকার করা হয় না, বরং এক শিল্পী অন্য শিল্পীর অর্জনের পাশে কোন অবস্থানে বর্তমান, তার একটি বোঝাপড়া সম্ভবপর হয়ে ওঠে।
রৈখিকতানির্ভর শিশির নিজস্ব উপাদান ও অবয়বধর্মিতা নিয়েই দর্শকের সামনে হাজির হয়েছেন।আন্দাজ করে বলা যায়, নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকেই রেখাকেন্দ্রিক নির্মাণ মারফত এই শিল্পীর নতুনতর অধ্যায়ের সূচনা। এই ধারার কাজ প্রথম দর্শক সমীপে পেশ করেন ২০০৮ সালে ‘কায়া’তে অনুষ্ঠিত একক চিত্র প্রদর্শনীতে। যেহেতু খণ্ডতা থেকে তিনি সমাজের প্রত্যক্ষ বাস্তবকে অনুভব ও নির্মাণ করেন, তার ক্যানভাস বা কাগজের পরিসরে খণ্ডচিত্রের সমারোহ লক্ষণীয়। বর্তমান প্রদর্শনীর কাজগুলোয় হাতকাটা মানুষ, খেলনা কবুতর, মুখমণ্ডল থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া হাসি, কবুতর পেটে মোজা পরা বিড়াল, দুমুখী কুকুর—এসবই প্রতীক হিসেবে জাতীয় অবক্ষয়ের দিকে নির্দেশ করে।
বলা বাহুল্য, বিগত পাঁচ থেকে ছয় বছরে শিশির রাজনৈতিক ভাবনার চেয়ে জাতীয়তা ও সেই সূত্রে দেখা সাংস্কৃতিক-সামাজিক এমনকি প্রাকৃতিক বাস্তবতার দিকে বেশ মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। ফুল, ঘাস, পাতা, ডালপালা—এসবের ইলাস্ট্রেশনসুলভ যোজন তাঁর রেখাচিত্রের তির্যক দৃষ্টিকে অনেকটাই সহনীয় করে তুলেছে।
বেশ ও আসল চেহারা—এই দুইয়ের তফাত দূর করে যে বাস্তব পাঠ করা জরুরি, কিছু সূত্রের মধ্য দিয়ে তিনি তা পেশ করেন। যেমন হাতের ওপর হাত মোজাসুলভ আরেকটি হাত।মানব-চেহারায় প্রাণীর মুখোশ, কোনো প্রাণীর নিজ স্বভাববিরোধী কোনো কর্মে লিপ্ত হওয়া, যেমন কুকুরের পোকা খাওয়ার লোভ।
পাকিস্তান সৃষ্টি ও ধর্মকেন্দ্রিক পরিচয়ের যে রাজনীতি, শিশির বরাবরই সেই প্রপঞ্চে তির্যক দৃষ্টিপাত করেছেন। এই প্রদর্শনীতেও একাত্তরের গণহত্যার স্মারক ও ইয়াহিয়ার ব্যঙ্গচিত্র স্থান করে নিয়েছে। লঘু ও গুরুচৈতন্য—এই দুই ধারা তাঁর বর্তমান কাজে বহমান আছে। এর সম্ভাবনার দিকটি অসীম।
শিশির ভট্টাচার্য্য আশির দশকের আবির্ভূত প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম একজন। সামাজিক ভাষ্য নির্মাণের সূত্রে বাংলাদেশের শিল্পের ইতিহাসে তাঁর জায়গা বিশিষ্টের।বর্তমান প্রদর্শনী যে বিচারে দর্শকের চোখে কোন মাত্রায় ধরা পড়বে, তা প্রত্যেকের পরিপ্রেক্ষিতের ওপর নির্ভরশীল।
১৭ মার্চ/নিউজরুম