অচেনা অমরার পাঠ

0
226
Print Friendly, PDF & Email

সৃজন আর বিশ্বাস শিল্পী দিলারা বেগম জলির শিল্পচেতনায় নতুন সত্তা নির্মাণ করেছেতাঁর দৃপ্ত পদচারণ শিল্পের রহস্যময়তায়, আবার আনন্দময় অভিযাত্রায়অন্য এক পৃথিবী নির্মাণ বা শিল্পের অহর্নিশ খোঁজ তাঁকে নিয়ে চলেছে গতিময়তার দিকেসব সময়ই সঙ্গী হিসেবে পাশে পেয়েছেন মা আর জীবনসঙ্গী শিল্পী ঢালী আল মামুনকেকিন্তু শিল্প সৃজন মূলত একাকিত্বেই অবগাহনসমকালীন চিত্রকলায় তাঁর শৈল্পিক অভিব্যক্তি ব্যতিক্রমী কি না তা সময়ের ওপর ছেড়ে দিলেও তাঁর বলার ধরন, ভাষা, পথের বিস্মৃতি এবং গন্তব্যের নিশানায় নিঃশব্দ নৈঃসঙ্গ্যের সঙ্গেই যাবতীয় বিনিময়রং-রেখা-ইমেজের স্বাধীনতায় তিনি জন্ম দিয়েছেন অভিব্যক্তির অবারিত সমুদ্রঅবচেতনের ভাব, নিজস্ব সময়-আদর্শকে তিনি চিত্রকলায় উন্মুক্ত করেছেন
বর্তমানে শিল্পী দিলারা বেগম জলির শিল্পকর্ম যে ভাবনাতে আচ্ছন্ন, তা একজন নারীর একান্ত মাতৃত্বের অনুভূতিসম্প্রতি অমরাশিরোনামে তাঁর একটি সিরিজে এই ভাবনার ধারাবাহিক রূপকল্প দেখা যায়তিনি একজন নারীর জীবনের প্রতিটি ধাপের পরিবর্তিত রূপ নিয়ে ভাবছেনগত এক বছরের দুঃসহ স্মৃতি শিল্পী জলিকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে চলেছেজীবন-মৃত্যুকে পাশাপাশি রেখে নিঃস্ব হতে দেখেছেন তিনিপ্রায়ই ভাবেন, এই দুর্ঘটনায় যে মা তাঁর সন্তান হারিয়েছেন, তাঁর মানসিক অবস্থা কেমন, কী করে কাটছে তাঁর দিনগুলোযদিও এই শহর মানবিকতাকে দূরে ঠেলে এগিয়েছে বহুদূর! শিল্পী জলির এই অমরাসিরিজ শিল্পকর্মে কোনো দুর্ঘটনার ইমেজ নেই; কিন্তু আছে একজন মা তাঁর সন্তান, সন্তানধারণের সময়কাল, দীর্ঘ অপেক্ষা, ভ্রূণের বেড়ে ওঠা, জন্মমুহূর্ত, জীবনের নানান ধাপ আর এখন এই পরিণতি! এভাবেই তিনি দেখিয়েছেন সন্তানের মৃত্যু একজন মায়ের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করেক্যানভাসে একটি ফুল, যা ইউট্রেসের প্রতীকী উপস্থাপনড্রইং-রেখা-রং ক্যানভাসে বিলীন করে একটি সমৃদ্ধ জগ সৃজন করেছে
বন্ধু তারেক মাসুদের মায়ের একটি আর্তি শিল্পী জলির কানে এখনো বাজে: আমার আদরের ছেলে, ভালোবাসা, স্বপ্নসব আজ মাটির নিচে শুয়ে আছে; ওর সাথে আমিও চলে গিয়েছি, শুধু আমার শরীরের বাইরটা তোমরা দেখতে পাও’—এই ভাবনাই মূলত এই সিরিজের প্রতিচ্ছবিএকজন নারী বা মায়ের দুঃখ-কষ্ট-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন এইসব অনুভূতির বিভিন্ন প্রকাশভঙ্গি তাঁর চিত্রপটে এসেছেক্যানভাসে তাঁর দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোটাই একটি নারীর আকাঙ্ক্ষা থেকেএই সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি, সীমাবদ্ধতা ক্রমাগত হতাশা তৈরি করেআবার জীবন ও অনিবার্য সত্যকে সমান্তরাল পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও নারীর সংগ্রামসংগ্রামে তাঁর মানসিক অবস্থার অভিমুখ আর আত্মস্বরূপ উপলব্ধি একজন শিল্পী সৃজনশীলতায় উন্মোচন করতে পারেনশিল্পী জলি এমনই এক অবস্থানে রয়েছেনতিনি অনিবার্য বাস্তবতাকে বহন করে চলেছেন; ওপরিতলের জীবনে অন্তর্লীন বেদনা প্রকাশ পায় না কখনোইতাই শিল্পসৃজনের মগ্নতায় তিনি বেদনাকে কালোত্তীর্ণতায় ছড়িয়ে দেনশিল্পীর ভাষায়জন্ম-মৃত্যু-ভালোবাসা মিলান্তি খেলা
স্বপ্ন কখনো বা একটি ফুলসেই স্বপ্ন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেঘর তৈরি করছে স্বপ্ন দিয়েই; আর সমাজের ঘাত-প্রতিঘাত, নির্মম বাস্তবতায় নিমজ্জিত হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গনকফিন ঢেকে যায় স্বপ্ন বা ফুল দিয়েইজীবনের পুনর্বিন্যাস সবুজ বৃক্ষ-নীল পাতা-হলুদ পাখি-নিঃসঙ্গ মাছএমন সব চিত্রকল্পে আবর্তিত শিল্পী জলির মনোজগ

দিলারা বেগম জলি: ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেনতবে শিল্পীর আদি নিবাস খুলনাচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে বিএফএ করেন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে ১৯৮৪ সালে এমএফএ শেষ করেনশান্তিনিকেতন থেকে ছাপচিত্রে তিনি ডিগ্রি গ্রহণ করেনতিনি দেশে-বিদেশে নানা যৌথ এবং একক প্রদর্শনী করেছেনএ ছাড়া জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে তিনি দুবার পুরস্কৃত হয়েছেন

 

১৬ মার্চ, ২০১৩,

 

শেয়ার করুন