সৃজন আর বিশ্বাস শিল্পী দিলারা বেগম জলির শিল্পচেতনায় নতুন সত্তা নির্মাণ করেছে। তাঁর দৃপ্ত পদচারণ শিল্পের রহস্যময়তায়, আবার আনন্দময় অভিযাত্রায়। অন্য এক পৃথিবী নির্মাণ বা শিল্পের অহর্নিশ খোঁজ তাঁকে নিয়ে চলেছে গতিময়তার দিকে। সব সময়ই সঙ্গী হিসেবে পাশে পেয়েছেন মা আর জীবনসঙ্গী শিল্পী ঢালী আল মামুনকে। কিন্তু শিল্প সৃজন মূলত একাকিত্বেই অবগাহন। সমকালীন চিত্রকলায় তাঁর শৈল্পিক অভিব্যক্তি ব্যতিক্রমী কি না তা সময়ের ওপর ছেড়ে দিলেও তাঁর বলার ধরন, ভাষা, পথের বিস্মৃতি এবং গন্তব্যের নিশানায় নিঃশব্দ নৈঃসঙ্গ্যের সঙ্গেই যাবতীয় বিনিময়। রং-রেখা-ইমেজের স্বাধীনতায় তিনি জন্ম দিয়েছেন অভিব্যক্তির অবারিত সমুদ্র। অবচেতনের ভাব, নিজস্ব সময়-আদর্শকে তিনি চিত্রকলায় উন্মুক্ত করেছেন।
বর্তমানে শিল্পী দিলারা বেগম জলির শিল্পকর্ম যে ভাবনাতে আচ্ছন্ন, তা একজন নারীর একান্ত মাতৃত্বের অনুভূতি। সম্প্রতি ‘অমরা’ শিরোনামে তাঁর একটি সিরিজে এই ভাবনার ধারাবাহিক রূপকল্প দেখা যায়। তিনি একজন নারীর জীবনের প্রতিটি ধাপের পরিবর্তিত রূপ নিয়ে ভাবছেন। গত এক বছরের দুঃসহ স্মৃতি শিল্পী জলিকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে চলেছে। জীবন-মৃত্যুকে পাশাপাশি রেখে নিঃস্ব হতে দেখেছেন তিনি। প্রায়ই ভাবেন, এই দুর্ঘটনায় যে মা তাঁর সন্তান হারিয়েছেন, তাঁর মানসিক অবস্থা কেমন, কী করে কাটছে তাঁর দিনগুলো। যদিও এই শহর মানবিকতাকে দূরে ঠেলে এগিয়েছে বহুদূর! শিল্পী জলির এই ‘অমরা’ সিরিজ শিল্পকর্মে কোনো দুর্ঘটনার ইমেজ নেই; কিন্তু আছে একজন মা তাঁর সন্তান, সন্তানধারণের সময়কাল, দীর্ঘ অপেক্ষা, ভ্রূণের বেড়ে ওঠা, জন্মমুহূর্ত, জীবনের নানান ধাপ আর এখন এই পরিণতি! এভাবেই তিনি দেখিয়েছেন সন্তানের মৃত্যু একজন মায়ের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ক্যানভাসে একটি ফুল, যা ইউট্রেসের প্রতীকী উপস্থাপন। ড্রইং-রেখা-রং ক্যানভাসে বিলীন করে একটি সমৃদ্ধ জগৎ সৃজন করেছে।
বন্ধু তারেক মাসুদের মায়ের একটি আর্তি শিল্পী জলির কানে এখনো বাজে: ‘আমার আদরের ছেলে, ভালোবাসা, স্বপ্ন—সব আজ মাটির নিচে শুয়ে আছে; ওর সাথে আমিও চলে গিয়েছি, শুধু আমার শরীরের বাইরটা তোমরা দেখতে পাও’—এই ভাবনাই মূলত এই সিরিজের প্রতিচ্ছবি। একজন নারী বা মায়ের দুঃখ-কষ্ট-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন এইসব অনুভূতির বিভিন্ন প্রকাশভঙ্গি তাঁর চিত্রপটে এসেছে। ক্যানভাসে তাঁর দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোটাই একটি নারীর আকাঙ্ক্ষা থেকে। এই সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি, সীমাবদ্ধতা ক্রমাগত হতাশা তৈরি করে। আবার জীবন ও অনিবার্য সত্যকে সমান্তরাল পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও নারীর সংগ্রাম। সংগ্রামে তাঁর মানসিক অবস্থার অভিমুখ আর আত্মস্বরূপ উপলব্ধি একজন শিল্পী সৃজনশীলতায় উন্মোচন করতে পারেন। শিল্পী জলি এমনই এক অবস্থানে রয়েছেন। তিনি অনিবার্য বাস্তবতাকে বহন করে চলেছেন; ওপরিতলের জীবনে অন্তর্লীন বেদনা প্রকাশ পায় না কখনোই। তাই শিল্পসৃজনের মগ্নতায় তিনি বেদনাকে কালোত্তীর্ণতায় ছড়িয়ে দেন। শিল্পীর ভাষায় ‘জন্ম-মৃত্যু-ভালোবাসা মিলান্তি খেলা’।
‘স্বপ্ন কখনো বা একটি ফুল—সেই স্বপ্ন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে—ঘর তৈরি করছে স্বপ্ন দিয়েই; আর সমাজের ঘাত-প্রতিঘাত, নির্মম বাস্তবতায় নিমজ্জিত হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন—কফিন ঢেকে যায় স্বপ্ন বা ফুল দিয়েই। জীবনের পুনর্বিন্যাস সবুজ বৃক্ষ-নীল পাতা-হলুদ পাখি-নিঃসঙ্গ মাছ’ এমন সব চিত্রকল্পে আবর্তিত শিল্পী জলির মনোজগৎ।
দিলারা বেগম জলি: ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে শিল্পীর আদি নিবাস খুলনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে বিএফএ করেন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে ১৯৮৪ সালে এমএফএ শেষ করেন। শান্তিনিকেতন থেকে ছাপচিত্রে তিনি ডিগ্রি গ্রহণ করেন।তিনি দেশে-বিদেশে নানা যৌথ এবং একক প্রদর্শনী করেছেন। এ ছাড়া জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে তিনি দুবার পুরস্কৃত হয়েছেন।
১৬ মার্চ, ২০১৩,