১৬ মার্চ, ২০১৩, রাজশাহী সিল্কের একজন বড় উদ্যোক্তা সদর আলী। ১৯৭৯ সালে তিনি পারিবারিক পর্যায়ে এই ব্যবসা শুরু করেন। নিজেই ফেরি করে সিল্ক কাপড় বিক্রি করতেন।এরপর ১৯৮৫ সালে রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরে একটি প্লট বরাদ্দ পান তিনি। মাত্র ৭০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে একটি ছোট ঘরে সপুরা সিল্ক মিল নামে একটি শিল্প ইউনিট শুরু করেন তিনি। তখন এর কর্মীসংখ্যা ছিল মাত্র সাতজন। এখন সদর আলীর সপুরা সিল্ক দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। নিজের কর্মী দিয়ে চাহিদা মেটাতে পারেন না, তাই বাইরে থেকেও কাজ করান। এটা ক্ষুদ্র শিল্পের একটি সফলতার গল্প।
সদর আলী প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরে গ্যাসের সংযোগ থাকলে উৎপাদন ব্যয় আরও কমত। ব্যবসায় খরচ কমলে তরুণ উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতেন। আর প্লট পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা কমাতে হবে।
১৯৯৬ সালে নওগাঁ বিসিক শিল্পনগরে মোহাম্মদ নাসিম একটি প্লট নিয়ে নাসিম ব্রাদার্স নামে একটি স্বয়ংক্রিয় চালকল চালু করেন। প্রথমে সাত-আটজন কর্মী নিয়োগ করেছিলেন।এখন অর্ধশতাধিক লোক কাজ করেন। এই দেড় দশকে যেমন বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন, তেমনি মুনাফার মুখও দেখেছেন।
এই চালকলের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে জানান, বিসিক শিল্পনগরে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ, আধুনিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অবকাঠামো সুবিধা দেওয়া হলে এ দেশে তরুণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন। সরকার শুধু সুবিধা নিশ্চিত করবে আর কর্মসংস্থান করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এই তরুণ উদ্যোক্তারাই।
এভাবেই চলছে দেশের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প। ছোট ছোট এই উদ্যোগে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তবে চাহিদা থাকার পরও পর্যাপ্ত অবকাঠামো-সুবিধা দিতে পারছে না সরকার। চাহিদা অনুযায়ী শিল্প প্লটও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তাদের শিল্পনগরগুলোতে মাত্র পাঁচ হাজার ৭১৯টি শিল্প ইউনিট স্থাপনের জন্য প্লট বরাদ্দ দিতে পেরেছে।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, এসব শিল্প ইউনিটের মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ইউনিটে জ্বালানি হিসেবে গ্যাস-সংযোগ রয়েছে।উত্তরাঞ্চলের কোনো শিল্পনগরে গ্যাস-সংযোগ নেই। আর খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের বেশ কিছু শিল্পনগরে গ্যাস-সংযোগ নেই। বিসিকের তথ্যানুসারে, সারা দেশে ৯৮ হাজার ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মানে, সারা দেশের ক্ষুদ্র শিল্পের মাত্র ৫ শতাংশের কিছু বেশি বিসিক শিল্পনগরে অবস্থিত। বাকি সব ক্ষুদ্র শিল্পই ব্যক্তি-মালিকানার জমিতে প্রতিষ্ঠিত। আর কুটিরশিল্পের সংখ্যা ছয় লাখ ৪০ হাজার ৯৩৯, যা এখনো পারিবারিক পর্যায়ে সীমিত রয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মিলিয়ে মোট ৩২ লাখ ২৮ হাজার লোক কাজ করছেন। ২০১১-১২ অর্থবছরের হিসাবে, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প খাতে মোট ২০ হাজার ৮০৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে।
মূলত খাদ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, হালকা প্রকৌশল, জামদানি, সিল্কসহ বস্ত্র, তৈরি পোশাকের অ্যাকসেসরিজ, কাচশিল্প—এসবেই ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে বিনিয়োগ করা হয়।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, বিসিকের ৭৯টি শিল্পনগরে মোট ১০ হাজার ৩৫০টি প্লট রয়েছে। এর মধ্যে নয় হাজার ৭৯১টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব প্লটে পাঁচ হাজার ৭১৯টি শিল্প ইউনিট স্থাপিত হয়েছে। আর উৎপাদনে রয়েছে চার হাজার ৮৭টি।
তবে পরিচালনা দুর্বলতা ও ব্যাংকঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে না পারায় ২৭৬টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘রুগ্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জমি ইজারা বাতিল করে নতুন উদ্যোক্তার কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে বিসিক সূত্রে জানা গেছে।
উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেন, একটি প্লটের জন্য আবেদন করলে তা বরাদ্দ পেতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যায়। তাই এসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী একসময় হতাশ হয়ে ফিরে যান।
বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদার তুলনায় সরকার ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প উদ্যোক্তাদের প্লট দিতে পারছে না, এটা ঠিক। তবে শিল্প ইউনিটের কারিগরি নকশা, গুদামঘর, কর্মীদের কর্মপরিবেশের জন্য পর্যাপ্ত স্থান—এসব বিবেচনা করেই সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তার জন্য কতটুকু জায়গা দরকার, তা চূড়ান্ত করে বিসিক।
সংজ্ঞা ও সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক: এদিকে কুটিরশিল্পের সংজ্ঞা ও সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কুটিরশিল্প নিয়ে যে সমীক্ষা পরিচালনা করেছে, তার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, প্রায় আট লাখ ৩০ হাজারের মতো কুটিরশিল্প রয়েছে। এটি বিসিকের হিসাবের তুলনায় প্রায় দুই লাখ বেশি। বিবিএসের হিসাবমতে, কুটিরশিল্পে সাড়ে ২৯ লাখ কর্মী রয়েছেন। আর বিসিকের হিসাবে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মিলিয়ে মোট ৩২ লাখ ২৮ হাজার কর্মী রয়েছেন।
সংজ্ঞা নিয়েও রয়েছে সমস্যা। সর্বশেষ শিল্পনীতি অনুযায়ী, পাঁচ লাখ টাকার কম বিনিয়োগ হবে এবং পারিবারিক সদস্যের সমন্বয়ে সদস্যসংখ্যা অনধিক ১০ জন হবে—এমন প্রতিষ্ঠানই কুটিরশিল্প হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবে। শিল্পনীতির সংজ্ঞায় কুটিরশিল্পে অবশ্যই উদ্যোক্তার পরিবারের একজন সদস্যকে কর্মী হিসেবে থাকা বাধ্যতামূলক। অন্যদিকে বিবিএসে সর্বশেষ পরিচালিত সমীক্ষার সংজ্ঞা অনুযায়ী, কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই পণ্য উৎপাদন করতে হবে। আর কর্মীসংখ্যা নয়জনের কম হতে হবে।