১৬ মার্চ, ২০১৩, ‘কী হে, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের উইকেট নিতেই তোমাদের এমন ত্রাহি মধুসূদন দশা!’
কুলাসেকারা-হেরাথদের এমন বলতেই পারেন তাঁরা দুজন।
একজন বাংলাদেশের বিপক্ষে হাত ঘোরালেই উইকেট পেতেন! কাল শ্রীলঙ্কার নেটে অনেকক্ষণ বোলিংও করলেন। ব্যাটসম্যানের প্র্যাকটিস তো হলোই, সঙ্গে নিজেরও।আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়লেও এখনো যে চুটিয়ে বিশ্ব পরিব্রাজক হয়ে টি-টোয়েন্টি খেলে যাচ্ছেন। নাম মুত্তিয়া মুরালিধরন।
আরেকজনের বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের প্রথম ওভারে হ্যাটট্রিকসহ ৪ উইকেট নেওয়ার অবিশ্বাস্য কীর্তি আছে। সেটি অবশ্য ওয়ানডেতে। সানগ্লাসে ঢাকা চোখের শ্যেন দৃষ্টিতে পেসারদের বোলিং দেখতে দেখতে ‘এই করো’ ‘ওই করো’ নির্দেশ দিচ্ছিলেন। নাম চামিন্ডা ভাস।
এই সিরিজেই শ্রীলঙ্কা দলে ‘ফিরেছেন’ দুজন। ভাস পেস বোলিং কোচ। মুরালি স্পিন উপদেষ্টা। গল টেস্টে বাংলাদেশের ৬৩৮ রান কি একটু হকচকিয়ে দিয়েছে তাঁদের? এমন বাংলাদেশ তো কখনো দেখেননি আগে।
২০০৭ সালে সর্বশেষ যেবার শ্রীলঙ্কা সফরে এসেছিল বাংলাদেশ, ক্যান্ডিতে তিন টেস্ট সিরিজের শেষটির আগে মুরালিধরন তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলেন, টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। একটুও উন্নতি করেনি। সেবার বাংলাদেশের এমনই পারফরম্যান্স যে প্রতিবাদ করারও উপায় ছিল না। সেই মুরালিই কাল স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। অন্তত ব্যাটিংয়ে তো বটেই।
চামিন্ডা ভাস খুব মৃদুভাষী। মুরালির মতো অত ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি বলেই চ্যাটাং-চ্যাটাং কথা বলা তাঁর ধাতেই নেই। গলে প্রথম টেস্টের আগেই বলেছিলেন, এই সিরিজটা আগের মতো হবে না। কারণ শ্রীলঙ্কার এই দলটাও অভিজ্ঞতার দিক থেকে খুব ঋদ্ধ নয়। কাল তিনি তাই ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম’ জাতীয় একটা হাসি দিয়ে পার পেয়ে গেলেন।
শ্রীলঙ্কান সাংবাদিকেরাও দাবি করছেন, বাংলাদেশ ৬৩৮ করে ফেলবে, এতটা না ভাবলেও শ্রীলঙ্কা দল জানত, এই সিরিজটা আগের মতো সহজ হবে না।এমন ভাবনার কারণ কী? ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঢাকা টেস্ট। যে টেস্টে ৫৫৬ রান করে লিড নিয়েছিল বাংলাদেশ।
ড্র মানে তো কারও জিত নয়, হারও নয়। গলের ড্র মোটেই তা নয়। শ্রীলঙ্কার জন্য তা পরাজয়ের সমান। আজ কলম্বোর প্রেমাদাসায় শুরু হতে যাওয়া দ্বিতীয় টেস্টে শ্রীলঙ্কা দলকে তাই এত দিনের পরীক্ষিত ফর্মুলায় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। নিজেদের দেশে গত ১৭টি টেস্টের মাত্র দুটিতে দুজন স্পেশালিস্ট স্পিনার খেলায়নি শ্রীলঙ্কা। ১৮তম টেস্টে তৃতীয়বারের মতো সম্ভবত ঘটতে যাচ্ছে এ ঘটনা। অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস স্বীকার করে নিচ্ছেন, যে অস্ত্রে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডের মতো দলকে বধ করা যায়, বাংলাদেশের বিপক্ষে তা ভোঁতা তরবারি। ‘ওরা স্পিনটা খুব ভালো খেলে’—ম্যাথুসের এই উপলব্ধির কারণেই প্রেমাদাসার উইকেটে সবুজ ঘাসের উঁকিঝুঁকি।
যা দেখে মুশফিকুর রহিম বলে দিচ্ছেন, ‘এই উইকেটে যদি আমাদের সমস্যা হয়, ওদেরও হবে।’ শ্রীলঙ্কায় কোনো টেস্ট ম্যাচের আগে বাংলাদেশের কোনো অধিনায়কের এমন দর্পিত উচ্চারণ ইতিহাসে এই প্রথম। গলে ওই ‘৬৩৮’-এর এমনই মাহাত্ম্য।
গলের উইকেট পেসার-স্পিনার কোনো বৈষম্য করেনি। সবার প্রতিই তা বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে। উইকেটে ঘাস আছে বলে প্রেমাদাসা পেসারদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। তবে সেই বন্ধুত্বের হাত কতক্ষণ প্রসারিত থাকবে, সেটি কেউই জানে না।
এমনিতে প্রেমাদাসা শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ভালো ব্যাটিং উইকেট বলে স্বীকৃত। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের (শ্রীলঙ্কার ৯৫২/৬) রেকর্ডটিই এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। তবে গত বিশ্বকাপের আগে মাটি-টাটি তুলে নতুন করে উইকেট বানানো হয়েছে। পেসারদের যেন মাথা কুটে না মরতে হয়, সেটি মাথায় রেখেই। কিন্তু এরপর তো এখানে হয়েছে শুধু ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি। টেস্টের পাঁচ দিনে সেটি কেমন রং বদলায়, সেটি তাই কারোরই জানা নেই।
বাংলাদেশ তো ২০০৫ সালের পর এখানে কোনো টেস্টই খেলেনি। এই মাঠে তাই শুধু মোহাম্মদ আশরাফুলেরই টেস্ট-স্মৃতি আছে। সেই স্মৃতি অবশ্য বিস্মরণযোগ্য। সেটি শুধু নিজের ব্যর্থতার কারণেই নয়, তৃতীয় দিন লাঞ্চের এক ঘণ্টা আগেই শেষ হয়ে যাওয়া টেস্ট কে মনে রাখতে চায়! দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৮৬ রানে শেষ হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। মূল হন্তারক ছিলেন ওই মুরালিধরন। মাত্র ১৮ রানে যিনি নিয়েছিলেন ৬ উইকেট!
তবে এবার কোনো স্পিনারের এমন বিধ্বংসী হয়ে ওঠাটা বোধ হয় একটু কঠিনই হবে। উইকেটে ঘাস ‘সিমার’ ‘সিমার’ বলে একটা রব তুলেছে। যা দুই দলকেই একাদশ নিয়ে নতুন করে ভাবতেও বাধ্য করছে। শ্রীলঙ্কার তিন পেসার নিয়ে খেলাটা একরকম নিশ্চিতই। দেশ থেকেই দুই পেসার-দুই স্পিনারের ছক মাথায় নিয়ে আসা বাংলাদেশও তিন পেসার খেলানোই ঠিক কি না ভাবনায় আক্রান্ত।যে কারণে কাল রাত পর্যন্ত একাদশ চূড়ান্ত নয়।
এনামুলের জায়গায় তামিম ইকবাল আসছেন। শাহাদাতের জায়গায় রুবেল হোসেন। ফিট থাকলে গলেও খেলতেন এই দুজন। দোদুল্যমানতা এখন রবিউল হোসেন, না আবদুর রাজ্জাক? আজ টসের আগে শেষবারের মতো উইকেট দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। রাজ্জাকের দিকেই একটু পাল্লা ভারী। ওয়ানডেতে দুর্দান্ত কিন্তু টেস্টে ব্যর্থ—এই অপবাদ গায়ে থাকার পরও রাজ্জাকের পক্ষে যাচ্ছে ‘সিমিং উইকেটই’! স্পিনারদের মধ্যে ব্যতিক্রমই বলতে হবে তাঁকে, উইকেটে একটু ঘাস-টাস থাকলে বরং তাঁর বোলিংটা বেশি খোলতাই হয়।
টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে বাংলাদেশ দলের সর্বোচ্চ স্বপ্ন ছিল একটা টেস্ট ড্র করা।গলেই সেই লক্ষ্য পূরণ হয়ে যাওয়ায় এখন সেটি সিরিজ ড্র করার স্বপ্নে রূপান্তরিত। প্রেমাদাসার পাঁচ দিন (?) কী নিয়ে অপেক্ষা করছে কে জানে, তবে শ্রীলঙ্কায় কোনো টেস্ট খেলতে নামার আগে এমন স্বপ্ন খেলা করেনি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের চোখে।
ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্ন বর্ণহীন হতে পারে, জীবনের স্বপ্ন তো সব সময়ই রঙিন!