১৬ মার্চ, ২০১৩, সময়টা ২০০৩ সাল। চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ের চিকিৎসক ডি কস্টার মো. হাফিজুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘তুমি তো আজব লোক! এত বড় একটা দুঃসংবাদ দিলাম, আর তুমি মুচকি মুচকি হাসছ?’ অসুখটার নাম রেটিনাইটিস পিগমেনটোসা। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ডি কস্টার হয়তো ভাবছিলেন, তাঁর রোগী অসুখের ভয়াবহতা ঠিক ধরতে পারেননি।
হাফিজুর রহমান ধরতে পেরেছিলেন ঠিকই, তবে ঘাবড়ে যাননি। ডি কস্টারকে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো চিকিৎসা নেই, সেটা বুঝলাম। কিন্তু আমি যেন একটুখানি লিখতে আর পড়তে পারি, এটুকু আলো কি আপনারা আমার চোখে দিতে পারেন না?’ হাফিজুর রহমানের বয়স তখন ৪০। ভালো চাকরি করেন। চাকরিটা টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও লিখতে আর পড়তে পারাটা তাঁর জন্য খুব জরুরি।
শংকর নেত্রালয়ের চিকিৎসকেরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। ডি কস্টার আবারও বসলেন হাফিজুর রহমানের সঙ্গে।বললেন, ‘তোমার গানের গলা তো বেশ ভালো, তুমি গায়ক হওয়ার চেষ্টা করছ না কেন? তা ছাড়া ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলেছ। তুমি কি জানো, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদেরও ক্রিকেট খেলার সুযোগ আছে? দেখেছ কখনো?’ হাফিজুর রহমান বললেন, ২০০০ সালে অফিসে বসে একবার টিভিতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ক্রিকেট তিনি দেখেছেন।
হাফিজুর রহমান তখনো জানতেন না, আর কয়েক বছর পরই তিনি হবেন বাংলাদেশ জাতীয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দেবেন সামনে থেকে!
আজিজ হেনা গ্রিন ভিলা
বাড়ির নাম আজিজ হেনা গ্রিন ভিলা।শুধু নামেই নয়, বাড়িজুড়েই এখনো এ এস এম আজিজুর রহমান, আর রহিমা খাতুন হেনার আধিপত্য। দেয়ালে টানানো ছবিগুলো তো আছেই, মা-বাবার আরও বহু স্মৃতি সযত্নে আগলে রেখেছেন হাফিজুর রহমান।
মা ছিলেন সংগীত অনুরাগী, বাবা ক্রিকেটার। মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে শিল্পী হোক। আর বাবা চাইতেন, হারমোনিয়ামের চেয়ে ব্যাট-বলটাই ছেলেকে বেশি টানুক। কিন্তু ছেলে যখন খুব ছোট, তখনই মা-বাবার স্বপ্নে আঘাত আসে। বুলেট ভাই বলছিলেন, ‘সমবয়সী অন্য শিশুরা যেমন স্বাভাবিকভাবে কথা বলত, আমি সেভাবে স্পষ্ট বলতে পারতাম না।সমস্যা হতো। মা শিক্ষিত ছিলেন। প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে ধারণাও ছিল। তিনিই আমাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। চিকিৎসার পাশাপাশি মায়ের সেবায় সে সময় এই সমস্যা কাটিয়ে উঠেছি।’
১৯৬৭ সালে ঢাকায় অবস্থিত শাহীন স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু। পড়ালেখার পাশাপাশি বাবা ছিলেন তাঁর ক্রিকেটের গুরু। ১৯৭২ সালে স্কুল ক্রিকেটে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে হাফিজুর রহমানের পুরোদস্তুর ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করে। একসময় ডাক পেলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড আয়োজিত অনূর্ধ্ব ১৬ ক্রিকেট প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শেষে পরিচিত কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘ইয়াং ক্রিকেটার্স ক্লাব’। পারিবারিক অ্যালবামের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সেই স্বপ্নিল দিনগুলোর কথাই বলছিলেন হাফিজুর রহমান, কাছের মানুষদের ‘বুলেট ভাই’।
মা-বাবা অজানার দেশে পাড়ি জমাতেই তাঁর স্বপ্নগুলোও হারিয়ে গেল কোথায় যেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে ধরতে হলো সংসারের হাল। শিল্পী কিংবা ক্রিকেটার নয়, তিনি তখন পুরোদস্তুর চাকরিজীবী। চাকরিজীবী হাফিজুর রহমানের দিনগুলোও ভালোই কাটছিল। ২০০৩ সাল নাগাদ রেটিনাইটিস পিগমেনটোসা আবার বদলে দিল তাঁর জীবনের মোড়। রঙিন পৃথিবীটা ক্রমেই ঝাপসা ঠেকতে শুরু করল তাঁর চোখে।
ক্রিকেটের আলো
ছবি তোলার জন্য আমরা তখন গেছি বুলেট ভাইয়ের বাড়ির পাশেই, মুকুল ফৌজের মাঠে। দুপুরের রোদে মাঠে ছেলেপুলেদের খেলা তখন জমে উঠেছে। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে বুলেট ভাইকে দেখে তাদের খেলা একটা অঘোষিত বিরতি পেয়ে গেল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়াল খুদে ক্রিকেটাররা। বুলেট ভাই তখন আমাদের দেখাচ্ছিলেন, কীভাবে তাঁরা বল করেন, বল ধরেন। ছেলেপুলেদের উপস্থিতি টের পেয়ে লাজুক হাসি হাসলেন তিনি। বললেন, ‘আমার বাড়ির পাশের মাঠ, ছোটবেলায় এখানে কত খেলেছি। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সি গায়ে কখনো আসা হয়নি।’
বুলেট ভাই রাস্তায় হাঁটাচলা করেন কারও সাহায্য ছাড়াই। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন, ‘একেবারে যে দেখি না, তা নয়। একটা চোখ পুরোপুরিই অকেজো। আরেক চোখে খুব অল্প দেখতে পাই। এই যে সামনেই ছোট্ট মেয়েটা হেঁটে যাচ্ছে, নীল জামা পরা, দেখতে পারছি। কিন্তু বাবুটার চেহারা বুঝতে পারছি না।’ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের দলে ১০ নম্বর জার্সির হাফিজুর রহমান খেলেন বি টু (আংশিক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী) হিসেবে। তিনি শুধু যে অধিনায়ক, তা নয়, বাংলাদেশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেটের অনেক গুরুদায়িত্বই তাঁর ওপর। স্কুল এবং জেলা পর্যায়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেটার গড়ে তোলার কাজ করছেন বহুদিন ধরে। ২০১২ সালে ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও খেলেছেন অধিনায়ক হিসেবে।
সুঠাম দেহের আত্মবিশ্বাসী মানুষটিকে দেখে কে বলবে, চোখের আলো হারিয়ে একসময় তাঁর ঘোর দুর্দিন গেছে। ছাড়তে হয়েছে চাকরিটা। আর্থিক টানাপোড়েনও নিস্তার দেয়নি। বহু কষ্টে ব্রেইল শিখেছেন। বুলেট বলছিলেন, ‘এ বয়সে এসে ব্রেইল শেখা যে কী ভীষণ কঠিন। রাত জেগে শিখতাম। খাতা কেনার মতো বিলাসিতা করারও সুযোগ ছিল না। ক্যালেন্ডারের পাতার পেছনে লিখতাম।’ সেসব ক্যালেন্ডারের পাতা এখনো সযত্নে সংগ্রহে রেখেছেন তিনি। সে সময় ক্রিকেটই তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছে।
ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বেশ কিছু সুখস্মৃতি জমা আছে বুলেট ভাইয়ের ভান্ডারে। বললেন, ‘বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচটা ছিল নেপালের বিরুদ্ধে। প্রথম ম্যাচের প্রথম বলটা আমি করেছি, এটা আমার জন্য খুব গর্বের ব্যাপার। যদিও এখনো আমরা জয় পাইনি, তবে একেবারেই তরুণ দল নিয়ে বিশ্বকাপে আমাদের যাত্রা শুরুটা খারাপ ছিল না।অস্ট্রেলিয়ার সাথে ম্যাচটায় আমরা বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলাম। ম্যাচ শেষে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক আমাকে একটা ব্যাট উপহার দিয়েছেন। ব্যাটটা সযত্নে রেখেছি।’
বই, গানের অ্যালবাম, সংগ্রহশালা, ওয়েবসাইট, ক্রিকেট একাডেমি…
‘আমি গান লিখি কেন, জানো?’ কথার ফাঁকে প্রশ্ন ছুড়লেন বুলেট। আমাদের নীরবতা থেকেই বুঝে নিলেন, উত্তরটা অজানা। নিজে থেকেই বললেন, ‘এমন অনেক কথা আছে, যেগুলো কাউকে বলা যায় না। বন্ধু, ভাই, বোন—কাউকেই নয়। সে কথাগুলো আমি গানে গানে বলে ফেলি। এই চালাকিটা আমি করি, বুঝলা?’ বলেই হা হা করে হাসলেন তিনি। শুধু যে লিখেন, তা নয়। গান গাইতেও পারেন। শিগগিরই সংগীত পরিচালক গোলাম সারোয়ারের তত্ত্বাবধানে আসছে তাঁর একক অ্যালবাম স্বপ্নীল। প্রতিটি গানই তাঁর নিজের লেখা। বললেন, ‘মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতেই এখনো গানের চর্চাটা করছি।’
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি ‘জ’ সফটওয়্যারের মাধ্যমে দিব্যি কম্পিউটারে কাজ করতে পারেন তিনি। নিজের জীবনকাহিনি নিয়ে লিখছেন বই, ব্লাইন্ড ক্রিকেটার বুলেট বলছি। বইটা একই সঙ্গে বাংলা আর ইংরেজিতে প্রকাশ করার ইচ্ছা তাঁর। আগামী বইমেলার কথা মাথায় রেখে প্রকাশকের খোঁজ করছেন তিনি।
বাংলাদেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ক্রিকেটের যাত্রা নিয়ে তৈরি করেছেন তথ্যচিত্র। এ ছাড়া একটি ওয়েবসাইট এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য একটি ক্রিকেট একাডেমি চালু করার স্বপ্ন তাঁর।
বয়সে হাফ সেঞ্চুরি ছুঁয়ে ফেলা মানুষটার এখন দিন কাটে ভীষণ ব্যস্ততায়। ডিজঅ্যাবল চাইল্ড ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন।দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেটার গড়তে ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।
কথা শেষে যখন বিদায় নিচ্ছি, হাফিজুর রহমানের বুলেট নামকরণের সার্থকতা ততক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে। দৃষ্টিশক্তি যতই ক্ষীণ হোক, অন্তরে যে তিনি বারুদ পোষেন!