১৬ মার্চ, ২০১৩, অত্যাধুনিক গাড়িগুলোর নাম ‘মোবাইল হোম মোটর ক্যারাভ্যান’। ট্রাক আকৃতির বিশাল এই গাড়ির ভেতরে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শয়ন কক্ষ, ডাইনিং, বাথরুম, টয়লেট—সবই আছে। বলা যায়, ‘ভ্রাম্যমাণ গাড়িঘর’। এই গাড়িঘরে চড়ে ৩৪ নারী-পুরুষের বিশ্বভ্রমণ। ১৭টি গাড়িঘরে ওদের কাটাতে হবে দুই বছরের বেশি সময় অর্থাৎ ৭০০ দিন। উদ্দেশ্য, বিশ্ব শান্তি ও পরিবেশ সংরক্ষণের বার্তা প্রচার করা। ‘অ্যারাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড টুর ইন সেভেন হান্ড্রেড ডেজ’ নামের এই বিশ্বভ্রমণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহযোগিতা দিচ্ছে জার্মানির একটি পর্যটন প্রতিষ্ঠান।
যেখান থেকে শুরু
২০১২ সালের ১০ অক্টোবর। তুরস্কের একটি শহর থেকে ৩৪ পর্যটকের গাড়ি বহর যাত্রা শুরু করে। কয়েক দিনের মাথায় তাঁরা ১৭টি গাড়ির বহর নিয়ে ঢুকে পড়েন জর্জিয়ায়। তারপর ইরান পার হয়ে পৌঁছেন পাকিস্তান। পাকিস্তান নিয়ে শুরু থেকে সবার মনে একটা ভয় কাজ করছিল, জঙ্গিরা হামলা করবে না তো? কঠোর নিরাপত্তায় তাঁরা পাকিস্তান-অধ্যায় শেষ করে প্রবেশ করেন ভারতে। ভারতের দিল্লি, রাজস্থান, গোয়া, জয়পুর, আগ্রা, ঘুরে কলকাতা হয়ে তাঁরা চলে যান নেপালে। সেখানে তিন দিনের ভ্রমণ শেষ করে আবার ভারত হয়ে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ ঢোকেন গত ২২ জানুয়ারি।এরপর যশোর, ঢাকা, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম হয়ে ১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে পৌঁছেন বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজারে। ওই দিন তাঁরা রাত কাটান পাথুরে সৈকত ইনানীর বন বিশ্রামাগারে।
‘এসকেপ বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি পর্যটকদের বাংলাদেশ ভ্রমণের বিপরীতে সহযোগিতা দিয়েছে।
দলের প্রধান জার্মান নাগরিক কোস্টিয়া (৬০) বলেন, ‘বিশ্বের দেশে দেশে যুদ্ধ, হানাহানি ও সহিংসতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণ হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশ ও দেশের নাগরিকেরা ঝুঁকির মধ্যে জীবন যাপন করছেন। তাই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পরিবেশ সুরক্ষার আবেদন নিয়ে আমরা ৭০০ দিনের জন্য বিশ্ব পরিভ্রমণে বের হয়েছি। কক্সবাজার পর্যন্ত আমরা ভালোভাবে এসেছি। বাকি পথটুকু ভালোভাবে যেতে পারলে লক্ষ্য পূরণ হবে।’
গাড়ি নয়, হোটেল
প্রতিটি গাড়ির বাসিন্দা একজন নারী একজন পুরুষ। দুজনই আবার গাড়ির চালক। একজন গাড়ি চালালে অন্যজন গাড়িতে বসে করেন রান্নাবান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। ক্লান্তি দূর করতে অথবা বিশ্রামের প্রয়োজন হলে কোথাও গাড়ি থামিয়ে সেটা সেরে ফেলা হয়। শোবার কক্ষে স্থাপন করা আছে অত্যাধুনিক মিডিয়া প্লেয়ার। আছে সিনেমা দেখা ও গান শোনার ব্যবস্থা। এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়ির যোগাযোগ করতে আছে শক্তিশালী ওয়্যারলেসসেট। জিপিএসের মাধ্যমে মুঠোফোনে তাঁরা পথঘাট চিহ্নিত করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশ-দেশান্তরে।
বাজার থেকেই দরকারি জিনিসপত্র নিজেরাই কেনাকাটা করেন। গাড়িতে রান্নাবান্না করে খান। বাসাবাড়ির মতো গাড়িতে ওঠার সিঁড়ি যেমন আছে, রয়েছে আলো-বাতাসের জন্য একাধিক জানালা। ভেজা কাপড়চোপড় রোদে শোকানোর জন্য গাড়ির ছাদে লাগানো আছে অ্যানটেনা। ভেতরে ঢুকলে মনে হবে গাড়ি নয়, যেন তারকা মানের হোটেলকক্ষ। ৩৪ যাত্রীর ২৬ জন জার্মান নাগরিক। গাড়িবহরে অন্য আটজন যুক্ত হয়েছেন সুইজারল্যান্ড, ইতালি ও অস্ট্রিয়া থেকে।
এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে যেখানে সাগর-নদী পড়ে, সেখানে গাড়িবহর পারাপারে ব্যবহার করা হচ্ছে জাহাজ বা বিশেষ ফেরি।
জার্মানি থেকে জাহাজে করে গাড়িবহর তুরস্কে এনে বিশ্বভ্রমণ শুরু হয়েছিল। ইরান, পাকিস্তান আর ভারতে তাঁদের নানা ঝক্কিঝামেলায় পড়তে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।
গাড়ি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অস্ট্রিয়ার নাগরিক হান্স (৫৫) বলেন, ‘নিজের বাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে গাড়িটি তৈরি করা হয়েছে।অন্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়তাম। বিশ্বভ্রমণের ৭০০ দিন আমরা এই গাড়িতেই থাকব।অন্য কোথাও রাত কাটানোর সুযোগ কারও নেই।’
সবচেয়ে সুন্দর সৈকত!
১ ফেব্রুয়ারি বিকেল তিনটা। একে একে বিশ্বভ্রমণের ১৭টি গাড়ি পৌঁছাল ইনানী সৈকতের বন বিশ্রামাগারে। তারপর সবাই নেমে পড়লেন সমুদ্রসৈকতে। বিশাল সমুদ্রসৈকত দেখে বিদেশি পর্যটকেরা শুরু করেন দৌড়ঝাঁপ, হইচই। মনে হলো, দীর্ঘদিন পর তাঁরা বন্দিদশা থেকে মুক্ত হলেন।
দলের প্রধান কোস্টিয়া বলেন, ‘পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণের সুযোগ আমার হয়েছে, কিন্তু এত সুন্দর সমুদ্রসৈকত কোথাও দেখিনি! একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে উঁচু পাহাড়ের অপরূপ মিলনদৃশ্য পৃথিবীর কোথাও নেই!
জার্মানি থেকে আসা ওজ্জুলা (৬৫) বলেন, ‘বাংলাদেশ খুব সুন্দর দেশ! সমুদ্রসৈকত আরও সুন্দর! কিন্তু রাস্তাগুলো খুব ছোট, গাড়ি চালাতে সমস্যা হয়। ছোট রাস্তায় অতিরিক্ত গাড়ি চলাচল করে।’
ইতালির উর সেল (৬৩) বলেন, ‘সন্ধ্যার পর সৈকতে অন্ধকার নেমে আসে। সৈকতে নামার বা হাঁটার রাস্তা তৈরি করে দিলে এই সৈকত আরও সুন্দর দেখাবে। এখানকার মানুষ খুব ভালো, অতিথিপরায়ণ। অনেকে আমাদের গাছের কচি ডাব, আপেল ও কলা খেতে দিয়েছেন।’
ভ্রমণদলের সদস্য হোয়াইটসেল (৫৫) বলেন, ‘বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে, তা আগে শুনিনি। সৈকতের পাশাপাশি কক্সবাজারে ইকো টুরিজম রিসোর্ট মারমেইড, লাইফগার্ড স্টেশন দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ’
এর আগে পর্যটকদের বন বিশ্রামাগারে কচি ডাব খেতে দিয়ে অভ্যর্থনা জানান কক্সবাজার (দক্ষিণ) বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) বিপুল কৃষ্ণ দাশ।
পরে অতিথিদের ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে কক্সবাজারের সৈকত, পাহাড়, নদী, ঝরনা, জীবজন্তু, প্রকৃতি, বন সুরক্ষার কর্মসূচিসহ পর্যটনের নানা দৃশ্য তুলে ধরেন আরণ্যকের সমন্বয়কারী আবদুল মান্নান।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) বিপুল কৃষ্ণ দাশ বিদেশিদের কক্সবাজার ভ্রমণে আসার জন্য ধন্যবাদ জানান।