জাগরণের সাধক-পুরুষ

0
210
Print Friendly, PDF & Email

১৫ মার্চ, ২০১৩, ওয়াহিদুল হক, ওয়াহিদুল ভাইয়ের প্রয়াণের পর ছয় বছর হতে চললতাঁর জন্মদিনে তাই তাঁর চলে যাওয়ার অনুভূতিই আমাদের আচ্ছন্ন করে বেশিএখন ফিরে তাকাতে গেলে সময়ের দূরত্ব থেকে দেখা তাঁর বিশেষ কোনো প্রতিরূপ মনের পর্দায় ভেসে উঠবে, যেটা নানাজন নানাভাবে উপলব্ধি করবেনতিনি তো ছিলেন প্রবলভাবে জীবনবাদী ও জাগরণবাদী, শিল্পের ও কর্মের নানা দিকে ছড়িয়ে রেখেছিলেন নিজেকে, এতই তাঁর বিস্তার যে মনে হতে পারে কোনো কেন্দ্রবিন্দু বুঝি ছিল না তাঁর জীবনের ও ভাবনারতারপরও এখন যখন তাঁর গোটা জীবন আমাদের সামনে মেলে ধরা আছে এবং আমরা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে চাই তাঁর সত্তা, তখন মনে জাগবে এক সত্যদ্রষ্টা মানব, যিনি সম্যক স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছেন সম্যক সংঘ গড়ার মানসে, সেই প্রব্রজ্যার ছবিটি বুঝি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে দৃষ্টিসীমায়কখনো মনে হবে সময়-সংলগ্ন নয় জাতিস্বরের এই উপলব্ধি, যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসা কোনো সুরবাণী এই, আবার সচকিত হয়ে আমরা দেখি সময়কে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করেছেন তিনি, বাস্তবভূমিতে দাঁড়িয়ে সংঘাত ও বিভাজনের আক্রমণ মোকাবিলা করে অশ্রুমোচনের সাধনা তিনি করে চলেন নিরন্তর, একাকী ও সংঘবদ্ধ দুভাবেইওয়াহিদুল হককে তাই আমরা দেখতে পাই তাঁর একধরনের নিঃসঙ্গতায়, সেই সঙ্গে তাঁকে পাই সংঘশক্তিতে, যে-সংঘ কোনো একক কেন্দ্র-নির্ভর নয়, জীবকোষের মতো যা ক্রমেই নিজেকে ছাপিয়ে জন্ম দিয়ে চলে আরও অগণিত কোষের, কেন্দ্রের ও সংঘেরনিরন্তর চলার এই সাধকের রূপটিই মনে ভাসে তাঁকে স্মরণকালে, যে-সাধনায় বৈরাগ্য ছিল না মোটেই, ছিল অযুত নবপ্রাণে নবশক্তি সঞ্চারে বিশাল আকুলতা, সংগীত ও শিল্পের অনুশীলন, অধ্যয়ন ও প্রসারণে যিনি পেতে চেয়েছেন এই মুক্তি, সমাজের মুক্তি
ওয়াহিদুল হক একান্তভাবেই বাংলার, বাংলাদেশে তাঁর মতো করে দেশকে ফিরে পাওয়ার সাধনা আরও কেউ কেউ হয়তো করেছেন, করে চলেছেন, কিন্তু সেই সাধনায় নবীন প্রাণ যুক্ত করার জন্য এমন উদগ্রীব ও আকুল প্রয়াস আর কেউ নিয়েছিলেন বলা যাবে নাতাঁর এই দেশব্রতী সাধনার মূলে ছিল বাঙালির জীবনসমগ্রতা, একই সঙ্গে বাঙালি ও বিশ্বমানব হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা, যে-সাধনা সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনা করে তাঁকে করতে হয়েছে, কেননা দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষময়তা সমাজদেহে সংক্রমিত হওয়ার সব রকম নেতির বিরুদ্ধে লড়াই করেই এই বাঙালিত্ব পেতে পারে প্রতিষ্ঠা ও স্ফূর্তিএই কাজে শিল্পের শক্তিময়তা তিনি ভালোভাবে জেনেছিলেন, জেনেছিলেন সংগীতের মধ্যে কীভাবে বাঙালিত্বের প্রাণভোমরা প্রবল বৈরিতা সত্ত্বেও বজায় রেখেছে আপন অসামপ্রদায়িক অস্তিত্ব ও পরম্পরা, সেই গানের মধ্য দিয়ে তিনি মুক্তিসাধনার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন৬১ সালের রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের সূত্রে যে অভিযাত্রা তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা সূচনা করেছিলেন, তা কীভাবে পল্লবিত হয়ে উঠল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে, সেই ইতিহাস মোটা দাগে আমাদের জানা রয়েছেকিন্তু এর পরতে পরতে মিশে আছে যে শ্রম ও সাধনা, তিল তিল করে জাতির মানস শিল্পরসে অভিষিক্ত করার প্রয়াস, সেই নিষ্ঠা, ত্যাগ ও শ্রমের পরিচয় কতটুকুই-বা আমরা জানিঅধিকন্তু এ প্রয়াস তো কেবল সীমিত ছিল না সংগীত বা শিল্পের সাধনায়, ’৬৪ সালের দাঙ্গা রুখতে যে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী জাহিদুর রহিম, রাত জেগে প্রহরায় ছিলেন ওয়াহিদুল হক, সেসবও তো সংগীত সাধনার অঙ্গ হয়ে উঠেছিলআর তাই বাঙালিত্বের মধ্য দিয়েই ঘটে দ্বিজাতিতত্ত্বের অবসান ও বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়, সেই সংগ্রাম যতটা রাজনৈতিক, ঠিক ততটাই সাংস্কৃতিকএই জাতীয়তাবোধের কেন্দ্রে যে উদার অসামপ্রদায়িক মানবতাবোধের অধিষ্ঠান, সেই বিবেচনা থেকে ওয়াহিদুল হক লিখতে পারেন, ‘বাঙালি এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে জাতীয় বিকাশের জন্য, দেশস্থ অপর সকল জাতিসত্তার বিকাশের জন্যদ্বিজাতিতত্ত্বের বিপরীতে একই কলুষতা-আক্রান্ত একজাতিতত্ত্ব ছিল না সাংস্কৃতিক চেতনা-সঞ্জাত বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বরং আপন জাতিসত্তার উপলব্ধি অপর জাতিসত্তার অস্বীকৃতি হতে পারে না, বিশেষভাবে সামপ্রদায়িক বিভেদচেতনার বিরুদ্ধে যে-জাতিসত্তার জাগরণ, সে ক্ষেত্রে অপর জাতিসত্তার প্রতি বিদ্বিষ্ট ভাব কিংবা তাদের অধিকার হরণ ও তাদের অস্তিত্বের ওপর হামলা তো সামপ্রদায়িক জাতীয়তাবোধের ঘৃণ্য প্রকাশ, যার বিপরীতে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবোধের অবস্থানবাঙালি জাতীয়তাবোধকে তাঁর এই স্বরূপে বুঝে নেওয়া আজ আরও জরুরি হয়ে উঠেছে যখন বাঙালিত্বের প্রকাশকে অপর জাতীয়তার অস্বীকৃতি হিসেবে চিহ্নিত করার মতলবি প্রয়াস চলছে জোরদারভাবে
আজ যখন একদিকে আমরা দেখি শাহবাগ চত্বর বিস্তার পায় দেশব্যাপী, ঘটে দেশসংলগ্ন ও মুক্তিযুদ্ধ-প্রাণিত হাজারো তরুণপ্রাণের জাগরণ, যাঁরা যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করার পাশাপাশি অসামপ্রদায়িক উদার সর্বজনীন রাষ্ট্রাদর্শকেও অবলম্বন করছেন বড়ভাবে, তখন মনে হয় দেশজুড়ে সংগীতসংস্কৃতির মুক্তিমন্ত্র নিয়ে ওয়াহিদুল ভাইয়ের প্রব্রজ্যার ফসলও তো সেখানে আমরা খুঁজে পাইবাঙালির সম্মিলিত ও সমন্বিত মুক্তিসাধনার শক্তিময়তার পরিচয় যেখানে আমরা পাই, সেখানে ওয়াহিদুল হককেও বুঝি দেখতে পাইসেই সঙ্গে আরও মনে পড়বে তাঁকে, যখন দেখি রামুর অগ্নিদগ্ধ বৌদ্ধবিহার, দেখি সামপ্রদায়িক বিদ্বেষ উসকে দিয়ে সংখ্যালঘুদের মন্দির ভাঙচুর, বসতিজুড়ে অগ্নিসংযোগ এবং হতবিহ্বল ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানুষের ঘাটতি, তখনো মনে পড়ে ওয়াহিদুল ভাইকে, দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর অশ্রুমোচনে তিনি তো সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন, কেননা এ যে তাঁর সংগীতের দায়, সংস্কৃতির দায়; এই দায় মোচন ব্যতিরেকে যে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, বাঙালির অসামপ্রদায়িক জাতিরাষ্ট্রআজকের দিনে ওয়াহিদুল হক তাই হয়ে ওঠেন আরও বিপুলভাবে আমাদের প্রেরণার উস এবং করণীয় সম্পাদনের নকিব
সামপ্রদায়িকতা প্রতিরোধ অর্থ কেবল দাঙ্গা রুখে দাঁড়ানো নয়, এ এক নিরন্তর সাধনা, হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণার অপনোদন তথা মোকাবিলা তো শুরু হয় মানস-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত সেই মন গড়ে তুলতে কত ধরনের প্রয়াসেই না ব্রতী ছিলেন ওয়াহিদুল হকদেশজুড়ে চারণের মতো ঘুরে বেরিয়েছেন, ঔপনিবেশিক ভাষায় যা মফঃস্বল, প্রান্তবর্তী, দূরে ঠেলে দেওয়া জনপদ, সেই সব বসতিতে, চাঁদপুরে, শ্রীমঙ্গলে, জয়পুরহাটে, কত না ছোট শহরে সংস্কৃতির জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় তিনি জাগ্রত করেছেন কত-না মানুষ, সেখানে তাঁর মূল উদ্দিষ্ট থাকে নবীন-নবীনা, আর তাই সবচেয়ে আনন্দ তিনি খুঁজে পান এই ঝাঁক-বাঁধা নবীনদের নিয়ে চলতেএখন যখন ফিরে তাকাই ওয়াহিদুল হকের জীবনপরিক্রমণের পথের দিকে, যে-ছবি সবচেয়ে গাঢ় হয়ে ভেসে ওঠে তা এই দাদাঠাকুরের প্রতিচ্ছবি, ধনঞ্জয় বৈরাগীর গীতসুধা কল্লোল, যেখানে সামনে চলেছেন এক খ্যাপা বাউল, মানবে যাঁর অপরিমেয় আস্থা, অসামপ্রদায়িক গণতান্ত্রিক স্বদেশের স্বপ্ন যিনি কখনো মুছে যেতে দেন নাসেই সাধক আজ আর নেই নয়ন সমুখে, কিন্তুু পড়ে আছে দিগন্তরেখায় মিলিয়ে যাওয়ার পথরেখা, আকাশ ও মাটির যেথায় মিলন, সেই যাত্রাপথের আনন্দগান তিনি যাঁদের অন্তরে গেঁথে দিয়েছেন, তাঁরা দেশজুড়ে বিস্তৃত, আপাতদৃষ্টিতে যত একক বা বিচ্ছিন্ন মনে হোক না কেন, সংস্কৃতির ঐক্যসূত্রে তাঁরা আবার সংহতও বটেআজকের এই সংকট ও সম্ভাবনাকালে, সামপ্রদায়িক হিংস্রতার মুখোমুখি বাস্তবে, তাঁদের ওপরও অনেক দায়িত্ব বর্তেছে, সংস্কৃতির যে সাধনা আকাশচারী হয়েও দাঁড়িয়ে রইবে শক্ত মাটিতে, সামপ্রদায়িকতা মোকাবিলায় দাঁড়াবে ক্ষতিগ্রস্তের পাশে, সংখ্যালঘুর পাশে সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষ থেকে নয়, এক ভূমিপুত্রের পাশে অপর ভূমিপুত্রের দায় থেকে, যেখানে সংখ্যার বিচার গৌণ, মানবই মুখ্য, যে ঐক্যবদ্ধ জাতিচেতনার মূলে রয়েছে অসামপ্রদায়িক বোধআজকের দায়িত্ব পালনে আপন ভূমিকা গ্রহণের মধ্য দিয়েই ঘটতে পারে ওয়াহিদুল হকের স্মৃতির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন

 

শেয়ার করুন