রুমার বিদেহী সত্তা

0
306
Print Friendly, PDF & Email

আমি রুমা, বয়েস সাতজীবনের পরিধির জন্য অতি অল্প সময়তবু এটুকু সময়ই আমার সঙ্গী হয়েছিলেন বাবা, মা, খালা-মামা এবং চাচা ফুফুরাদাদা ছিলেন নাদাদী তাদের বাড়িতেই থাকতেননানা-নানী মাঝে মধ্যে বেড়াতে আসতেনএদের সবার মাঝে একরত্তি মেয়ে আমি রুমাজীবনের কিছুটা সময় অতিবাহিত করার মুহূর্তটিতে টের পেয়েছিলাম কিছু ঘটনাপ্রবাহ

 

এখন আমি এপারেএপারে এলে কেউ শিশু থাকে নাসবার অনুভূতিগুলো তখন প্রখর হয়ে যায়অতীত বর্তমান সবই দেখা যায়দেখা যায় না শুধু ভবিষ্য, বাবা-চাচারা মিলে একান্নবর্তী পরিবারের বাসিন্দাবাবা প্রাইভেট কোম্পানিতে অল্প বেতনের চাকরিজীবীআর তাই বেশ বয়েস করেই বাবা বিয়ে করেছিলেন

 

বাবা ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষআর মাকেও মোটামুটি সুন্দরী বলা চলেবাইরে থেকে দেখলে যে কেউ ভাববে রাজজোটক সম্পর্কঅথচ ভেতরের কাহিনী ছিল অন্য রকম

 

হিসাবি মানুষেরা ভেবে থাকেন বেশি হিসাব-নিকাশ করে তারা বুঝি জিতে গেছেনআবার এই বেশি হিসাব-নিকাশটাই অনেক সময় কাল হয়ে যায়কারণ জীবন কখনো অঙ্কের নিয়ম মানে নাবাবা চাকরিজীবী মেয়ে পছন্দ করতেনমা বিয়ের অনেক আগে থেকেই চাকরি করতেনমায়ের বিয়ে হয়েছিল বেশ দেরি করেকারণ চাকরিজীবী মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল নাকী এক অজ্ঞাত কারণে মায়ের বিয়ের জন্য যারাই আসত তারা ভেতরে ভেতরে খোঁজখবর নেয়ার পর ফিরে যেতশেষ পর্যন্ত বাবার হিসাবের সঙ্গে মিলে গেল

 

দাদা-দাদী ছেলের পছন্দকেই পছন্দ হিসেবে মেনে নিলেনবাবা তার বিয়ের পর সংসার খরচ হিসেবে দাদীর হাতে খুব কম টাকাই দিতেনদাদী নির্বিরোধী মানুষএ নিয়ে তিনি কোন উচ্চবাচ্য করতেন নাদাদার পেনশন ও গ্র্যাচুয়িটির টাকাই খরচ করতেন

 

বাবা ছেলেমানুষী করে মাকে তার জমানো টাকার অঙ্ক ব্যাংকের আমানত পত্র দেখালেনএসব দেখে মায়ের চুস্থির হয়ে গেলমাথা গেল ঘুরে

 

ইতোমধ্যে বাবার টাকা-পয়সার পরিমাণ মায়ের আত্মীয়স্বজন জেনে গেলোতারা বাবাকে চাপ দিতে লাগল ফ্যাট কেনার জন্যনানী বাবাকে বললেন, স্ত্রীকে ভালোভাবে রাখাই তো স্বামীর কর্তব্য

 

বাবা তার শ্বশুরবাড়িতে উপযুক্ত জামাইআদর পেতেন নাবাবাকে দিয়ে তারা ফাই-ফরমাশ খাটাতশ্বশুরবাড়িতে যে আদর-আপ্যায়ন করা হয় বাবার তা ছিল নাইচ্ছে করেই ওরা বাবাকে ছোট করতএমন কি হঠা গেলে বাবাকে কেউ বসতে পর্যন্ত বলত না

 

বাবা এতে খুব দুঃখ পেতেন আর তার মাকে এসে বলতেনÑ বুঝলে মা, আমি ওই বাড়ির জামাই নই, চাকর

 

দাদী চাইতেন না তার ছেলে শ্বশুরবাড়ি যাকবাবা বলতেনÑ না গিয়ে উপায় কী? এমন কান্নাকাটি শুরু করে

 

আমার চাচী ছিলেন স্কুলশিক্ষকপ্রাইভেট পড়িয়ে তার পরিচিতি ও ব্যাপকতা লাভ করে

 

চাচীর বড় ভাই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিতবাবা ছিলেন বড় ব্যবসায়ীচাচী যখন-তখন বাবার বাড়ি চলে যেতেনএই সব দেখেশুনে মায়ের ভেতর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়মা নিজেকে মনে মনে ছোট ভাবতেনআর চাচীর প্রতি একধরনের প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা বোধ করতেন

 

আমার নানী প্রায়ই মেয়ের কাছে বেড়াতে আসতেনতিনি মেয়েকে জানতেনসে জন্য মেয়েকে নিয়ে তার শঙ্কাও ছিলযখনই বেড়াতে আসতেন তিনি মেয়েকে কিছু উপদেশ দিতেনএ জন্যই নানী এলে মায়ের মাঝে আর উত্তেজনা দেখা দিত না

 

মায়ের গুণের কোনো কমতি ছিল নামা চমকার গান গাইতেন, ছবি আঁকতেনরান্নার হাতও ভালো ছিলমায়ের হাতের রান্নার স্বাদ ভোলার নয়

 

আমার নানা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেনচেহারা জীর্ণ, কঙ্কালসারএ দিকে নানী নানার সেবা করতে গিয়ে কান্ত বুড়োকে অহরহ বকাঝকা করতে থাকেনএকদিন অতিষ্ঠ হয়ে বললেন বুড়ো মরলেও আমার শান্তি হয়কিন্তু দেখা গেল নানার আগেই নানীর মৃত্যু হলোহঠা একদিন মাথা ঘুরে পড়ে স্ট্রোক করে মারা গেলেনভাগ্যের কী পরিহাস! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নানাও মারা গেলেন

 

মা একা হয়ে গেলেনঅসম্ভব একাএ দিকে আমার দাদীও বেঁচে আছেন ওষুধের ওপরএরই মাঝে হার্ট অ্যাটাকও হয়ে যায়ঠিক সময় মতো চিকিসা হওয়াতে তিনি বেঁচে যানতবে কিছু-বিধিনিষেধের বেড়াজাল মেনে চলতে হয়নিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়া, উত্তেজিত না হওয়া, চিকার চেঁচামেচি না করা ইত্যাদি

 

অথচ বাড়িতে অহরহ এসবই ঘটতে লাগলদাদী যে ঘরে থাকতেন তার পাশের ঘরটাই ছিল বাবা-মায়েরসুতরাং ওদের ঝগড়া প্রায়ই দাদীর কানে আসতহঠা একদিন দাদী শুনলেন পাশের ঘরে কে যেন কার গালে সজোরে চড় মেরেছেদাদী ঘর থেকে বের হয়ে বাবাকে ডেকে বললেন, দেখ স্ত্রীলোকের গায়ে কখনো হাত তুলবে নাবাবা মুখ নিচু করে বললেন ঠিক আছে মাকিছু দিন বাদে আবার সেই চড়ের শব্দএবার আর দাদীর চোখ এড়ালো না- দাদী বললেন, এ কী? বউমা তুমি তোমার স্বামীর গায়ে হাত তুলছ? তাও আবার আমার সামনে?

 

আমি কি আপনার সামনে থাকতে চেয়েছি? আমি কতবার ফ্যাট কিনতে চেয়েছি?

 

সেদিন হঠা করে বাবার সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেলদাদীকে বললেন, তুমি তো নতুন দেখেছ মাতোমরা ভাব আমি মারছিআমাকেই উল্টো মার খেতে হয়মাঝে মধ্যে রাস্তা-ঘাটে এমনকি আমার বন্ধুর বাড়িতেও আমাকে এমন অপমানিত হতে হয়েছে

 

দাদী এসব শুনে অস্থির হয়ে গেলেনএগিয়ে এসে বললেন, এসব কী শুনি বউমা? বাবা আরো বললেন, আমাকে অযথা সন্দেহ করেযেকোনো নারীকে জড়িয়ে মিথ্যা কথা বলতে থাকেসিএনজিতে কোনো মহিলা পাশে বসলে সেটার জের আমাকে টানতে হয়

 

মা চেঁচামেচি শুরু করলেনসব মিথ্যে কথাবাবা বললেন, তুমি কসম করে বলত আমি এক বিন্দু মিথ্যা বলেছি কি না?

 

মা চিকার করতে থাকলেনআমার বাবা-মা নাই, তাই আমার নামে এই মিথ্যা অপবাদ?

 

মায়ের চিকারে চাচা-চাচী এগিয়ে এলেনচাচা এসে তার মাকে ধরলেনআবার না জানি দাদীর কোন অ্যাটাক হয়? দাদী চাচাকে বললেন, হাসুরে এসব কী শুনছি? আমার বেঁচে থেকে কী লাভ?

 

চাচা বললেন, ভাবী চিকার করবেন না

 

তাহলে কী করব? নম, নম করব নাকি? বিয়ের সময় মনে থাকে না যে বউয়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হয়? চাচা বললেন, এটা ভদ্রলোকের বাড়িএ বাড়িতে এত চেঁচামেচি চলবে না

 

মা এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেনতিনি চিকার করে বলতে লাগলেন, তোমরা কে কোথায় আছো শোনএবার আমার বেরিয়ে যাওয়ার পালামা দাদীকে বললেন, আপনি মুরব্বি মানুষআপনি এর সমাধান করুন

 

দাদী কথা বলতে পারছিলেন নাতবুও তিনি বললেন, তুমি শান্ত হও মাআমি সব সমস্যার সমাধান করবোমা শান্ত হলেন নাতিনি আমার ফুফুর বাড়িতে ফোন করে সব কাহিনীর বর্ণনা দিলেনতারা চাচাকে ফোন করলোমায়ের বিবরণের সাথে চাচার বিবরণ না মেলাতে ঘটনা সেখানেই ধামাচাপা পড়ে গেল

 

পরদিন বাবা যথারীতি অফিসে গেলেনরাতেও যথাসময়ে বাড়ি ফিরলেনএরপর ঝগড়ার এখানেই সমাপ্তিএর কিছু দিন পর ফুফু আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলেনফুফুর এক ননদ ছিলসে একদিন নাকি তার স্বামীকে একসাথে ভাত খাওয়ার জন্য ডেকেছিলকিন্তু তার স্বামী সেদিন তার সাথে ভাত খায়নি এ জন্য সে গায়ে পেট্রল ঢেলে আত্মহত্যা করতে যায়অবশেষে তার এক ভাগ্নে তাকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়ে তোলেফুফুর ননদ নাকি এমন রাগী ছিলেনযখন যা বলতেন তখন তা শুনতে হতোনা শুনলেই তিনি পাগলামি করতেনছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের বেশি আদরে উনি এ রকম হয়ে যানবেশি আদরের ফল এই পাগলামিতে গিয়ে পৌঁছে

 

অবশেষে বাবা একটি ফ্যাট কিনলেনমা তার মনমতো ঘর সাজালেনএগুলো আমার জন্মের আগের কাহিনী

 

বাড়ির সবাই ভাবলো মায়ের মনের ব্যাধিটা বোধ হয় কমেছেএরপর আমি মেয়ে হয়ে জন্মালামআমার নাম রাখা হলো রুমা, দেখতে দেখতে সময় পার হতে লাগলআমি আরেকটু বড় হলামআমার আকিকা দেয়া হলোআকিকাতে ছাগল জবাই দেয়া হলোঅনেক লোকজন দাওয়াত করা হলো

 

সময় আরো অতিবাহিত হলোআমার বয়স পাঁচ হলোআমাকে স্কুলে ভর্তির তোড়জোড় চলতে লাগলবাইরে থেকে মনে হতো সব ঠিক আছেকিন্তু আসলে কিছুই ঠিক ছিল নাঠিক যে নেই এটি বুঝতে পারত হেনা নামের আমাদের কাজের মেয়েটিআমাদের বাসার কাজের মেয়েটি আমারও দেখাশোনা করতআবার ঘরের সব কাজো করত

 

কাজের মেয়েটির বিয়ের কথা হলে মা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়তেনমা চাইতেন বাবা ঘরের কাজে সহায়তা করুকবাবা বই পড়তে এবং গান শুনতে পছন্দ করতেনঅথচ মা ছিলেন এর বিপরীতএকদিন বাবা রেগে গিয়ে বললেন, আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবো

 

ডিভোর্স দেয়ার আগে আমাকে ফ্যাট লিখে দাওসবাই বলেছিল সন্তান হওয়ার পর মা ঠিক হয়ে যাবেনকিন্তু মা ঠিক হলেন নাএরপর সাব্যস্ত হলো মাকে সাইকিয়ট্রিস্ট দেখানো হবেআমাদের এক আত্মীয় মোতিলাল এটাকে সাব্যস্ত করলেন সিজোফ্রেনিয়াকিন্তু মা কোনো মনস্তত্ত্ববিদের কাছে যেতে নারাজউনি বাবাকে বললেন, তোমরা আমাকে পাগল সাব্যস্ত করে ডিভোর্স করাতে চাও?

 

তবে মা যখন স্বাভাবিক থাকতেন তখন তার মতো ভালো মানুষ আর দ্বিতীয়টি ছিল নাকিন্তু ক্ষেপে গেলেই যা খুশি তা-ই করতেন

 

হেনা একদিন অবাক হয়ে দেখল মা ঘরে ভাঙচুর করছেন এবং হাতের কাছে যা পাচ্ছেন তাই দিয়ে বাবাকে আঘাত করছেনবাবার চোখ দিয়ে নীরবে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলবাবা এসব কথা কাউকে বলতে পারতেন নাঘটনাচক্রে ঠিকই একদিন লোক জানাজানি হয়ে গেলবাবা লোকলজ্জা ও ঘেন্নায় জড়োসড়ো হয়ে পড়তেন

 

দাদী বলতেন মানুষ তার কর্মফল ঠিকই ভোগ করেএর কিছু দিন পর হেনা মায়ের কথার ঝাঁজে কাজ ছেড়ে দিলোসেই সঙ্গে মায়ের এই সব কাহিনীও বাইরে ফাঁস করে দিতে লাগলএর কিছু দিন পর ঈদের কেনাকাটা নিয়ে আবার ঝামেলা হলোবাবা মায়ের মধ্যে মারামারি হলো

 

সেদিন রাতে বাবাকে মা খেতে দেননিনিজে খেয়ে আমাকে খাইয়ে দরজা আটকে দিলেনইচ্ছে করলে বাবা নিজে নিয়ে খেতে পারতেনকিন্তু লজ্জায় অপমানে সে রাতে কিছু খেলেন নাদাদী এসে শেষে বাবাকে খেতে দিলেনবাবা সেই রাতে আমার কাছে এলেন নাআমি বাবার জন্য কান্না জুড়ে দিলামমার রাগ বেড়ে গেলে আমাকেও বেদম পেটাতোআমি ব্যাকুল হয়ে বাবাকে ডাকতামআমি প্রশ্রয় পেয়ে যাব এ জন্য বাবাকে কাছে আসতে দেয়া হতো না

 

কিন্তু সেই রাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন নাআর মাকে ফোন করে বললেন তিনি আর মায়ের সাথে থাকবেন নাএদিকে মা দাদীকে জানিয়ে দিলেন তিনি আত্মহত্যা করে কাগজে লিখে রেখে যাবেন তার মৃত্যুর জন্য বাবা দায়ী

 

বাবা বললেন, আমি পরে আসবআজ মন ভালো নেইমা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলেন

 

গভীর রাতে মা আমার গলায় হাত দিলেন চোখে মুখে এক অমানুষিক অভিব্যক্তিআমার গলা টিপে ধরতে গিয়ে চমকে উঠলেনপ্রচণ্ড জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছেখবর শুনে বাবা ছুটে এলেনআমাকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হলোডাক্তারদের অনেক চেষ্টাতেও কিছু হলো নাআমি ওপার থেকে এপারে চলে এলামবাবা, দাদীসহ সবাই কান্নায় ভেঙে পড়লশুধু মা কাঁদতে পারলেন নাতিনি পাথর বনে গেলেনআর আমার বালিশটাকে বারবার গলা টেপার মতো আঁকড়ে ধরে বিড়বিড় করে পাগলের মতো বলতে থাকেনআমি খুনি, আমি খুনি

 

মায়ের সব ছিলবুকভরা ভালোবাসাও ছিলশুধু জানা ছিল না কী করে ভালোবাসতে হয়ভালোবাসা যে ত্যাগের ওপর প্রতিষ্ঠিত এ খবরটুকু ভোগবাদে নিমজ্জিত আত্মকেন্দ্রিকদের জানাবে কে?

 

 

 

১৪ মার্চ, ২০১৩

 

শেয়ার করুন