আমি রুমা, বয়েস সাত। জীবনের পরিধির জন্য অতি অল্প সময়। তবু এটুকু সময়ই আমার সঙ্গী হয়েছিলেন বাবা, মা, খালা-মামা এবং চাচা ফুফুরা। দাদা ছিলেন না। দাদী তাদের বাড়িতেই থাকতেন। নানা-নানী মাঝে মধ্যে বেড়াতে আসতেন। এদের সবার মাঝে একরত্তি মেয়ে আমি রুমা। জীবনের কিছুটা সময় অতিবাহিত করার মুহূর্তটিতে টের পেয়েছিলাম কিছু ঘটনাপ্রবাহ।
এখন আমি এপারে। এপারে এলে কেউ শিশু থাকে না। সবার অনুভূতিগুলো তখন প্রখর হয়ে যায়।অতীত বর্তমান সবই দেখা যায়। দেখা যায় না শুধু ভবিষ্যৎ, বাবা-চাচারা মিলে একান্নবর্তী পরিবারের বাসিন্দা। বাবা প্রাইভেট কোম্পানিতে অল্প বেতনের চাকরিজীবী। আর তাই বেশ বয়েস করেই বাবা বিয়ে করেছিলেন।
বাবা ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ। আর মাকেও মোটামুটি সুন্দরী বলা চলে। বাইরে থেকে দেখলে যে কেউ ভাববে রাজজোটক সম্পর্ক। অথচ ভেতরের কাহিনী ছিল অন্য রকম।
হিসাবি মানুষেরা ভেবে থাকেন বেশি হিসাব-নিকাশ করে তারা বুঝি জিতে গেছেন। আবার এই বেশি হিসাব-নিকাশটাই অনেক সময় কাল হয়ে যায়। কারণ জীবন কখনো অঙ্কের নিয়ম মানে না। বাবা চাকরিজীবী মেয়ে পছন্দ করতেন। মা বিয়ের অনেক আগে থেকেই চাকরি করতেন। মায়ের বিয়ে হয়েছিল বেশ দেরি করে। কারণ চাকরিজীবী মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। কী এক অজ্ঞাত কারণে মায়ের বিয়ের জন্য যারাই আসত তারা ভেতরে ভেতরে খোঁজখবর নেয়ার পর ফিরে যেত। শেষ পর্যন্ত বাবার হিসাবের সঙ্গে মিলে গেল।
দাদা-দাদী ছেলের পছন্দকেই পছন্দ হিসেবে মেনে নিলেন। বাবা তার বিয়ের পর সংসার খরচ হিসেবে দাদীর হাতে খুব কম টাকাই দিতেন। দাদী নির্বিরোধী মানুষ। এ নিয়ে তিনি কোন উচ্চবাচ্য করতেন না। দাদার পেনশন ও গ্র্যাচুয়িটির টাকাই খরচ করতেন।
বাবা ছেলেমানুষী করে মাকে তার জমানো টাকার অঙ্ক ব্যাংকের আমানত পত্র দেখালেন। এসব দেখে মায়ের চুস্থির হয়ে গেল। মাথা গেল ঘুরে।
ইতোমধ্যে বাবার টাকা-পয়সার পরিমাণ মায়ের আত্মীয়স্বজন জেনে গেলো। তারা বাবাকে চাপ দিতে লাগল ফ্যাট কেনার জন্য। নানী বাবাকে বললেন, স্ত্রীকে ভালোভাবে রাখাই তো স্বামীর কর্তব্য।
বাবা তার শ্বশুরবাড়িতে উপযুক্ত জামাইআদর পেতেন না। বাবাকে দিয়ে তারা ফাই-ফরমাশ খাটাত। শ্বশুরবাড়িতে যে আদর-আপ্যায়ন করা হয় বাবার তা ছিল না। ইচ্ছে করেই ওরা বাবাকে ছোট করত। এমন কি হঠাৎ গেলে বাবাকে কেউ বসতে পর্যন্ত বলত না।
বাবা এতে খুব দুঃখ পেতেন আর তার মাকে এসে বলতেনÑ বুঝলে মা, আমি ওই বাড়ির জামাই নই, চাকর।
দাদী চাইতেন না তার ছেলে শ্বশুরবাড়ি যাক। বাবা বলতেনÑ না গিয়ে উপায় কী? এমন কান্নাকাটি শুরু করে।
আমার চাচী ছিলেন স্কুলশিক্ষক। প্রাইভেট পড়িয়ে তার পরিচিতি ও ব্যাপকতা লাভ করে।
চাচীর বড় ভাই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত। বাবা ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। চাচী যখন-তখন বাবার বাড়ি চলে যেতেন। এই সব দেখেশুনে মায়ের ভেতর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। মা নিজেকে মনে মনে ছোট ভাবতেন। আর চাচীর প্রতি একধরনের প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা বোধ করতেন।
আমার নানী প্রায়ই মেয়ের কাছে বেড়াতে আসতেন। তিনি মেয়েকে জানতেন। সে জন্য মেয়েকে নিয়ে তার শঙ্কাও ছিল। যখনই বেড়াতে আসতেন তিনি মেয়েকে কিছু উপদেশ দিতেন। এ জন্যই নানী এলে মায়ের মাঝে আর উত্তেজনা দেখা দিত না।
মায়ের গুণের কোনো কমতি ছিল না। মা চমৎকার গান গাইতেন, ছবি আঁকতেন। রান্নার হাতও ভালো ছিল। মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ ভোলার নয়।
আমার নানা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। চেহারা জীর্ণ, কঙ্কালসার। এ দিকে নানী নানার সেবা করতে গিয়ে কান্ত বুড়োকে অহরহ বকাঝকা করতে থাকেন। একদিন অতিষ্ঠ হয়ে বললেন বুড়ো মরলেও আমার শান্তি হয়। কিন্তু দেখা গেল নানার আগেই নানীর মৃত্যু হলো। হঠাৎ একদিন মাথা ঘুরে পড়ে স্ট্রোক করে মারা গেলেন। ভাগ্যের কী পরিহাস! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নানাও মারা গেলেন।
মা একা হয়ে গেলেন।অসম্ভব একা। এ দিকে আমার দাদীও বেঁচে আছেন ওষুধের ওপর। এরই মাঝে হার্ট অ্যাটাকও হয়ে যায়। ঠিক সময় মতো চিকিৎসা হওয়াতে তিনি বেঁচে যান। তবে কিছু-বিধিনিষেধের বেড়াজাল মেনে চলতে হয়। নিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়া, উত্তেজিত না হওয়া, চিৎকার চেঁচামেচি না করা ইত্যাদি।
অথচ বাড়িতে অহরহ এসবই ঘটতে লাগল। দাদী যে ঘরে থাকতেন তার পাশের ঘরটাই ছিল বাবা-মায়ের।সুতরাং ওদের ঝগড়া প্রায়ই দাদীর কানে আসত। হঠাৎ একদিন দাদী শুনলেন পাশের ঘরে কে যেন কার গালে সজোরে চড় মেরেছে। দাদী ঘর থেকে বের হয়ে বাবাকে ডেকে বললেন, দেখ স্ত্রীলোকের গায়ে কখনো হাত তুলবে না। বাবা মুখ নিচু করে বললেন ঠিক আছে মা। কিছু দিন বাদে আবার সেই চড়ের শব্দ। এবার আর দাদীর চোখ এড়ালো না- দাদী বললেন, এ কী? বউমা তুমি তোমার স্বামীর গায়ে হাত তুলছ? তাও আবার আমার সামনে?
আমি কি আপনার সামনে থাকতে চেয়েছি? আমি কতবার ফ্যাট কিনতে চেয়েছি?
সেদিন হঠাৎ করে বাবার সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল। দাদীকে বললেন, তুমি তো নতুন দেখেছ মা। তোমরা ভাব আমি মারছি। আমাকেই উল্টো মার খেতে হয়। মাঝে মধ্যে রাস্তা-ঘাটে এমনকি আমার বন্ধুর বাড়িতেও আমাকে এমন অপমানিত হতে হয়েছে।
দাদী এসব শুনে অস্থির হয়ে গেলেন। এগিয়ে এসে বললেন, এসব কী শুনি বউমা? বাবা আরো বললেন, আমাকে অযথা সন্দেহ করে। যেকোনো নারীকে জড়িয়ে মিথ্যা কথা বলতে থাকে। সিএনজিতে কোনো মহিলা পাশে বসলে সেটার জের আমাকে টানতে হয়।
মা চেঁচামেচি শুরু করলেন। সব মিথ্যে কথা। বাবা বললেন, তুমি কসম করে বলত আমি এক বিন্দু মিথ্যা বলেছি কি না?
মা চিৎকার করতে থাকলেন। আমার বাবা-মা নাই, তাই আমার নামে এই মিথ্যা অপবাদ?
মায়ের চিৎকারে চাচা-চাচী এগিয়ে এলেন। চাচা এসে তার মাকে ধরলেন। আবার না জানি দাদীর কোন অ্যাটাক হয়? দাদী চাচাকে বললেন, হাসুরে এসব কী শুনছি? আমার বেঁচে থেকে কী লাভ?
চাচা বললেন, ভাবী চিৎকার করবেন না।
তাহলে কী করব? নম, নম করব নাকি? বিয়ের সময় মনে থাকে না যে বউয়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হয়? চাচা বললেন, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। এ বাড়িতে এত চেঁচামেচি চলবে না।
মা এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, তোমরা কে কোথায় আছো শোন। এবার আমার বেরিয়ে যাওয়ার পালা। মা দাদীকে বললেন, আপনি মুরব্বি মানুষ। আপনি এর সমাধান করুন।
দাদী কথা বলতে পারছিলেন না। তবুও তিনি বললেন, তুমি শান্ত হও মা। আমি সব সমস্যার সমাধান করবো। মা শান্ত হলেন না। তিনি আমার ফুফুর বাড়িতে ফোন করে সব কাহিনীর বর্ণনা দিলেন। তারা চাচাকে ফোন করলো। মায়ের বিবরণের সাথে চাচার বিবরণ না মেলাতে ঘটনা সেখানেই ধামাচাপা পড়ে গেল।
পরদিন বাবা যথারীতি অফিসে গেলেন। রাতেও যথাসময়ে বাড়ি ফিরলেন। এরপর ঝগড়ার এখানেই সমাপ্তি।এর কিছু দিন পর ফুফু আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলেন। ফুফুর এক ননদ ছিল। সে একদিন নাকি তার স্বামীকে একসাথে ভাত খাওয়ার জন্য ডেকেছিল। কিন্তু তার স্বামী সেদিন তার সাথে ভাত খায়নি এ জন্য সে গায়ে পেট্রল ঢেলে আত্মহত্যা করতে যায়। অবশেষে তার এক ভাগ্নে তাকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়ে তোলে। ফুফুর ননদ নাকি এমন রাগী ছিলেন। যখন যা বলতেন তখন তা শুনতে হতো। না শুনলেই তিনি পাগলামি করতেন। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের বেশি আদরে উনি এ রকম হয়ে যান।বেশি আদরের ফল এই পাগলামিতে গিয়ে পৌঁছে।
অবশেষে বাবা একটি ফ্যাট কিনলেন। মা তার মনমতো ঘর সাজালেন। এগুলো আমার জন্মের আগের কাহিনী।
বাড়ির সবাই ভাবলো মায়ের মনের ব্যাধিটা বোধ হয় কমেছে। এরপর আমি মেয়ে হয়ে জন্মালাম। আমার নাম রাখা হলো রুমা, দেখতে দেখতে সময় পার হতে লাগল। আমি আরেকটু বড় হলাম। আমার আকিকা দেয়া হলো। আকিকাতে ছাগল জবাই দেয়া হলো। অনেক লোকজন দাওয়াত করা হলো।
সময় আরো অতিবাহিত হলো। আমার বয়স পাঁচ হলো।আমাকে স্কুলে ভর্তির তোড়জোড় চলতে লাগল। বাইরে থেকে মনে হতো সব ঠিক আছে।কিন্তু আসলে কিছুই ঠিক ছিল না। ঠিক যে নেই এটি বুঝতে পারত হেনা নামের আমাদের কাজের মেয়েটি। আমাদের বাসার কাজের মেয়েটি আমারও দেখাশোনা করত।আবার ঘরের সব কাজো করত।
কাজের মেয়েটির বিয়ের কথা হলে মা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়তেন। মা চাইতেন বাবা ঘরের কাজে সহায়তা করুক। বাবা বই পড়তে এবং গান শুনতে পছন্দ করতেন। অথচ মা ছিলেন এর বিপরীত। একদিন বাবা রেগে গিয়ে বললেন, আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবো।
ডিভোর্স দেয়ার আগে আমাকে ফ্যাট লিখে দাও। সবাই বলেছিল সন্তান হওয়ার পর মা ঠিক হয়ে যাবেন। কিন্তু মা ঠিক হলেন না। এরপর সাব্যস্ত হলো মাকে সাইকিয়ট্রিস্ট দেখানো হবে। আমাদের এক আত্মীয় মোতিলাল এটাকে সাব্যস্ত করলেন সিজোফ্রেনিয়া। কিন্তু মা কোনো মনস্তত্ত্ববিদের কাছে যেতে নারাজ। উনি বাবাকে বললেন, তোমরা আমাকে পাগল সাব্যস্ত করে ডিভোর্স করাতে চাও?
তবে মা যখন স্বাভাবিক থাকতেন তখন তার মতো ভালো মানুষ আর দ্বিতীয়টি ছিল না। কিন্তু ক্ষেপে গেলেই যা খুশি তা-ই করতেন।
হেনা একদিন অবাক হয়ে দেখল মা ঘরে ভাঙচুর করছেন এবং হাতের কাছে যা পাচ্ছেন তাই দিয়ে বাবাকে আঘাত করছেন। বাবার চোখ দিয়ে নীরবে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল।বাবা এসব কথা কাউকে বলতে পারতেন না। ঘটনাচক্রে ঠিকই একদিন লোক জানাজানি হয়ে গেল। বাবা লোকলজ্জা ও ঘেন্নায় জড়োসড়ো হয়ে পড়তেন।
দাদী বলতেন মানুষ তার কর্মফল ঠিকই ভোগ করে। এর কিছু দিন পর হেনা মায়ের কথার ঝাঁজে কাজ ছেড়ে দিলো। সেই সঙ্গে মায়ের এই সব কাহিনীও বাইরে ফাঁস করে দিতে লাগল। এর কিছু দিন পর ঈদের কেনাকাটা নিয়ে আবার ঝামেলা হলো। বাবা মায়ের মধ্যে মারামারি হলো।
সেদিন রাতে বাবাকে মা খেতে দেননি। নিজে খেয়ে আমাকে খাইয়ে দরজা আটকে দিলেন। ইচ্ছে করলে বাবা নিজে নিয়ে খেতে পারতেন।কিন্তু লজ্জায় অপমানে সে রাতে কিছু খেলেন না। দাদী এসে শেষে বাবাকে খেতে দিলেন। বাবা সেই রাতে আমার কাছে এলেন না। আমি বাবার জন্য কান্না জুড়ে দিলাম। মার রাগ বেড়ে গেলে আমাকেও বেদম পেটাতো। আমি ব্যাকুল হয়ে বাবাকে ডাকতাম। আমি প্রশ্রয় পেয়ে যাব এ জন্য বাবাকে কাছে আসতে দেয়া হতো না।
কিন্তু সেই রাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন না। আর মাকে ফোন করে বললেন তিনি আর মায়ের সাথে থাকবেন না। এদিকে মা দাদীকে জানিয়ে দিলেন তিনি আত্মহত্যা করে কাগজে লিখে রেখে যাবেন তার মৃত্যুর জন্য বাবা দায়ী।
বাবা বললেন, আমি পরে আসব। আজ মন ভালো নেই। মা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলেন।
গভীর রাতে মা আমার গলায় হাত দিলেন চোখে মুখে এক অমানুষিক অভিব্যক্তি। আমার গলা টিপে ধরতে গিয়ে চমকে উঠলেন। প্রচণ্ড জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। খবর শুনে বাবা ছুটে এলেন। আমাকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ডাক্তারদের অনেক চেষ্টাতেও কিছু হলো না। আমি ওপার থেকে এপারে চলে এলাম। বাবা, দাদীসহ সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ল। শুধু মা কাঁদতে পারলেন না। তিনি পাথর বনে গেলেন। আর আমার বালিশটাকে বারবার গলা টেপার মতো আঁকড়ে ধরে বিড়বিড় করে পাগলের মতো বলতে থাকেন। আমি খুনি, আমি খুনি।
মায়ের সব ছিল। বুকভরা ভালোবাসাও ছিল। শুধু জানা ছিল না কী করে ভালোবাসতে হয়। ভালোবাসা যে ত্যাগের ওপর প্রতিষ্ঠিত এ খবরটুকু ভোগবাদে নিমজ্জিত আত্মকেন্দ্রিকদের জানাবে কে?
১৪ মার্চ, ২০১৩