স্পোর্টস ডেস্ক:জয় নাকি একটা দলকে আমূল বদলে দিতে পারে। ড্র-ও কি তা-ই পারে! মনে তো হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে যে দলটি শ্রীলঙ্কায় এসেছিল, গত পরশু গল থেকে কলম্বোয় এল কি সেই একই দল! ধন্দে পড়ে যেতে হচ্ছে। খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষায় আত্মবিশ্বাসের বিচ্ছুরণ।মুখেও সেটির অসংকোচ প্রকাশ। একটা ড্রয়ের এমন মহিমা!
টেস্ট ম্যাচ তো বাংলাদেশ আগেও ড্র করেছে। এমনও নয় যে তার সব কটিই বৃষ্টির আনুকূল্যধন্য।সেসব ড্রয়ের কোনোটিই তো এমন ‘নতুন দিনের সূচনা’ বলে সমস্বর কোরাস তোলেনি।কোথায় এসে তাহলে গলের ড্রটা আলাদা হয়ে যাচ্ছে?
শ্রীলঙ্কায় এর আগের ৮টি টেস্টের দুঃসহ স্মৃতি অবশ্যই একটা কারণ। তবে আসল কারণ এটি নয়। সেটি লুকিয়ে আছে গলের ওই পাঁচ দিনেই। লুকিয়ে আছে দুটি ইনিংসে। মুশফিকুর রহিমের ২০০ আর মোহাম্মদ আশরাফুলের ১৯০ শুধুই সংখ্যাতত্ত্বের সীমানা ছাড়িয়ে পরিণত বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী দুটি ইনিংসে।
এমনই যে, রানবন্যার ওই টেস্টে একটি রানও করতে না-পারা মাহমুদউল্লাহ ব্যক্তিগত দুঃখকে হাসির আড়ালে ঢেকে বলতে পারছেন, ‘এই টেস্টটা আমাদের স্বপ্নের পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে।’ জহুরুল ইসলাম সেই স্বপ্নটাকে ছড়িয়ে যেতে দেখছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, ‘ভবিষ্যতের তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি এখন আর অসম্ভব কোনো স্বপ্ন হয়ে থাকবে না। মুশফিক ২০০ করেছে, আশরাফুল ১৯০—আমাদের দলের অন্য ব্যাটসম্যানরাও এখন ভাববে, ওরা যদি পারে, আমরা কেন পারব না? তামিম এত ভালো ব্যাটসম্যান, অনেক সেঞ্চুরি করেছে, এখন ও বড় বড় সেঞ্চুরি করার কথা ভাববে।’
বাংলাদেশ দলের বিশ্রামের দিনে কাল ব্যাটিং প্র্যাকটিস করতে গিয়েছিলেন শুধু তামিম ইকবাল। দ্বিতীয় টেস্টে খেলা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তাঁর স্বপ্নও এখন আর শুধুই একটা সেঞ্চুরিতে সীমাবদ্ধ নয়।বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের স্বপ্নের সীমা যে এখন ‘বড় সেঞ্চুরি’তে বিস্তৃত!
তামিম পরিবর্তনটা খুব টের পাচ্ছেন, ‘সত্যি কথা বললে, এত দিন আমি ডাবল সেঞ্চুরির কথা ভাবলেও সেটির পাশে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকত। মুশফিক আর আশরাফুল ভাইয়ের ইনিংস দুটি সেই প্রশ্নচিহ্নটাকে দূর করে দিয়েছে। শুধু আমার নয়, বাকি সবার সামনেই একটা উদাহরণ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।’
ডাবল সেঞ্চুরি আর প্রায় ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংস দুটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মোহাম্মদ আশরাফুলের ‘প্রায় ডাবল সেঞ্চুরি’টার কথাই আগে বলতে চাইলেন তামিম। বললেনও এত চমৎকার যে তাঁর জবানিতেই তা তুলে দিতে ইচ্ছা করছে—
আশরাফুলের ১৯০ নিয়ে তামিম ইকবাল: ‘রান করা এক জিনিস আর চাপের মধ্যে রান করা আরেক জিনিস। সবকিছু পক্ষে থাকলে যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই রান করাটা সহজ হয়ে যায়। আশরাফুল ভাইয়ের ইনিংসটাকে আমি “স্পেশাল” বলব, কারণ কোনো কিছুই তাঁর পক্ষে ছিল না। ২৫ জনের দলে ছিলেন না। প্রস্তুতি ম্যাচেও খেলবেন কি না খেলবেন না ঠিক ছিল না। উনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার। উত্থান-পতন সবই দেখেছেন। এবারও তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এই অসম্ভব চাপ মাথায় নিয়ে যে ইনিংসটা খেলেছেন, সেটির তুলনা হয় না। বাংলাদেশের পক্ষে এর চেয়ে ভালো ইনিংসও হয়তো আমি দেখেছি, তবে এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে কাউকে খেলতে দেখিনি। উনি প্রমাণ করেছেন, চাইলে উনি মেন্টালি কত স্ট্রং হতে পারেন।’
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের সময় আশরাফুল যখন দলের বাইরে, তখনো একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, তাঁর চোখে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ আশরাফুল। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তামিম বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, বলেই অমন বলেছিলাম। উনি নিজের সামর্থ্যের প্রতি সুবিচার করতেন না। ওনাকে টিপস দিচ্ছি না, তবে আমার অনুরোধ থাকবে উনি এমন গেমপ্ল্যান নিয়েই যেন ব্যাটিং করেন। তাহলে এমন ইনিংস আমরা অনেক দেখতে পারব।’
মুশফিকুর রহিমের ২০০ নিয়ে তামিম: ‘আইডল বলতে যা বোঝায়, মুশফিক হলো তা-ই। ওর পারফরম্যান্স হয়তো সুপারস্টারের মতো ছিল না। তবে ওর নিবেদন, শৃঙ্খলাবোধ দলের বাকি সবার জন্য দারুণ উদাহরণ। ওর সবকিছু এত গোছানো! কেউ যদি সবকিছু এমন ঠিকভাবে করে যায়, তাঁর প্রাপ্তিটা তো বেঠিক হতে পারে না। মুশফিক ডাবল সেঞ্চুরি করায় আমি তাই একটুও অবাক হইনি। ওর যে কোয়ালিটি, তাতে এটা ফ্লুক নয়। আমি ওর ব্যাটিংয়ের বড় ভক্ত। বিশেষ করে এক বছর ধরে এমন ব্যাটিং করছে যে ও নামলেই বাংলাদেশের সবাই কিছু আশা করে। দেখবেন, ও আরও অনেক কিছু করবে।’
ব্যাটসম্যানরা ব্যাটিং-কীর্তিতে অনুপ্রাণিত হবেন, সেটিই স্বাভাবিক। তবে মুশফিকুর রহিম ও মোহাম্মদ আশরাফুলের ইনিংস দুটি শুধু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদেরই নয়, স্বপ্নের সীমানা বড় করে দিয়েছে পুরো দলেরই। অফ স্পিনার সোহাগ গাজী যেমন বললেন, ‘ব্যাটসম্যানরা পেরেছে, আমরা বোলাররাও পারব। আমাদের যে কারও পক্ষে যেকোনো কিছু করা সম্ভব, ওই ইনিংস দুটি সবার মনে এই বিশ্বাস ছড়িয়ে দিয়েছে।’
সেই বিশ্বাসই সিরিজ শুরুর আগের স্বপ্নটাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে।সিরিজ শুরুর আগে ‘অন্তত একটি টেস্ট ড্র করতে চাই’ এখন ‘সিরিজ ড্র করতে চাই’ স্বপ্নে রূপান্তরিত। সেই স্বপ্ন স্বপ্নও থেকে যেতে পারে। কিন্তু সেটি ভাবার সাহসটাই কি কম কিছু!
মূলে ওই দুটি ইনিংস!
১৪ মার্চ/নিউজরুম