সম্পর্কের প্রত্নতত্ত্ব এ নামে ডাকা প্রদর্শনীটা, এ নাম এর মাঝেই রেখে গেছে ভাবনার গভীরতা, দ্ব্যর্থতা আবার বহুমাত্রিকতা, প্রত্নতত্ত্বীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে সম্পর্কের সুদূর-গভীরতা, সুগভীর পুরাতনতা, পুরোনো সম্পর্কের সুসংহত যূথবদ্ধতার যাবতীয় সিম্বলিজম। প্রত্নতাত্ত্বিকতা প্রথমেই মনকে টেনে নেয় দূর- স্মৃতিময়তার নস্টালজিক অনুভবের সুপ্রথিত সুগভীরে।
আর এই নস্টালজিয়া হতে হবে ‘সম্পর্কের’, অর্থাৎ মানসিক এক রসায়নের, যা অনেক অনেক দিন আগের বা যে সম্পর্ক অনেক যত্নে বয়ে আনা আজ অবধি দূরত্বের, তবু তাকে খননের মাধ্যমে নবরূপে আবিষ্কার করতে হবে। আর এই খননের মাঝে আছে সযত্ন কারিগরি দক্ষতা, স্বপ্রাণের লুকানো আদর, জীবনযাপনের ব্যাপৃত বিবিধ অভিজ্ঞতা।
‘সম্পর্ক আর তার প্রত্নতত্ত্ব’ দ্বি-অর্থীয় বাঙময়তায় প্রস্ফুটিত। কেননা আমরা কখনো ভাবতে চাইনি আমাদের ভাব-অনুভূতি-হূদ্ধ সম্পর্ককে প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতির মাঝে খুঁজে বা খুঁড়ে বের করতে। ‘সম্পর্ক’ নিজেই এক অধরা-বাস্তবতা, ভাবের অনুভব, আর যখন তা প্রত্নতাত্ত্বিকতার মাঝে আবিষ্কারের প্রয়াস, তখন তা উপস্থাপন করে বহুমাত্রার সিম্বলিস্টিক নস্টালজিয়াদের।
শিল্পীদয় বাস্তবজীবনে সহধর্মী, আর বাস্তব অবলোকনে তাদের কাজের মাঝেও আছে এক সহধর্মী স্বভাব, একজন চটের বুনটকে উপস্থাপন করছেন তাঁর শিল্পী-কল্পে, যে চট ছিল সুদূর অতীতের সাক্ষী, তেমনি অন্যজন কল্পলোকে চিত্রিত করেছেন ফলমূলের জন্য ব্যবহূত পাতলা তক্তার বাক্সের পুরোনো অনুষঙ্গ। চটের বুনটে উপস্থাপিত হয়েছে ছিঁড়ে যাওয়া, বুনটে-খুলে ভাঁজ হয়ে যাওয়া এক দূরবর্তী সময়ের কর্মযজ্ঞ, আর পাতলা-কাঠের-তক্তা কখনো পোড়া ছাপে অঙ্কিত, কখনো পুরোনো লৌহ-কব্জায় জোড়া, অথবা চিরে যাওয়া এবড়োখেবড়ো হওয়া আর এক পুরাতনতা। কখনো তক্তার টেক্সচারের পুরোনো স্বাদে জংধরা তারকাঁটা দিয়ে সেঁটে দিচ্ছেন একের ওপর আর এককে, আবার কখনো তক্তার টেক্সচারশিল্পীর ব্রাশের আঁচড়ে নবতর রূপে ধরা দিচ্ছে দর্শকের দৃষ্টিতে। আর চটের ছিঁড়ে ফেলা লম্বা ফালিগুলোকে শিল্পী বিবিধ কম্পোজিশনে মেলে ধরেছেন, কখনো বা হরাইজোনটালি, কখনো বা কৌনিকতায় অথবা দড়ির আকৃতিতে অথবা সেলাইয়ের বুননে, এ ছাড়া ব্যবহার করেছেন জিনসের বুনট, রঙিন সুতার বাঁধন, সেলাইয়ের ফোঁড়, অথবা কখনো বাজার করার প্যাকেটের হাত, সবই যেন অদ্ভুত মাত্রায় ফুটে উঠেছে স্মৃতিময়তার নস্টালজিকতায়।
যে বিশেষ এক-দিক দু-শিল্পীর কাজে মেলবন্ধন হিসেবে আমাদের দৃষ্টিকে উৎকর্ণ করে, তা হলো রঙের ব্যবহার। সবচেয়ে দ্বি-আর্থিক যোজনতা এখানেই ফুটে ওঠে, যখন আমরা অনুভব করি ম্যাটেরিয়ালের স্মৃতিময়তা, অথচ তা উৎকীর্ণ হয় পরিচ্ছন্ন উজ্জ্বল রঙের ব্যাপ্তির মাধ্যমে। এই রঙের উজ্জ্বলতা যেন সম্পর্কের প্রত্নতাত্ত্বিকতাকে সুগভীর আপনতায় হূদ্ধ করে।
সাঈদ আর নাহিদের ‘সম্পর্কের-প্রত্নতত্ত্ব’ যেন তাঁদেরই বাস্তবজীবনের অনু-আলেক্ষ্য। তাঁরা যে জীবন নিয়ে বেড়ে উঠেছেন, যে কর্মজীবনের ব্যস্ততা, বেকারি আর ফলমূলের কেনাবেচা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যে চটের বুনট বা ফলের কাঠ- বাক্সের স্তূপকৃত তক্তার খুলে যাওয়া রিপিটিশন— সব মিলিয়ে সেই দীর্ঘ সুদূর সময়ে ফিরে যাওয়া, স্বপ্নিল রঙে উন্মিলিত চটের উজ্জ্বল স্মৃতিময়তা, অথবা ফেটে যাওয়া তক্তার বাক্সের ওপর ছুঁয়ে দেওয়া মিষ্টি রঙের প্রলেপ, এ যেন সাঈদ আর নাহিদের বিমূর্ত স্মৃতিময়তার নস্টালজিক চিত্রায়ণ।
বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টস্ আয়োজিত কাজী সাঈদ আহমেদ এবং সরকার
নাহিদ নিয়াজীর ‘সম্পর্কের প্রত্নতত্ত্ব’ শীর্ষক চিত্র প্রদর্শনী ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়।