১০ মার্চ, ২০১৩, ৫ মার্চ ২০১৩ লোকান্তরিত হয়েছেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ। তাঁরজন্ম ২৮ জুলাই ১৯৫৪। ২০০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনেতিনি এই বক্তব্য দেন
সাম্রাজ্যবাদীরা সবকিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকরতে চায়, বলে তারা নাকি ‘গণতন্ত্র’ আনবে। হ্যাঁ, সে গণতন্ত্র হবেঅভিজাতদের গণতন্ত্র, যা কিনা প্রতিষ্ঠিত হবে অস্ত্রের ঝনঝনানি আর বিস্ফোরিতবোমার ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে। কী অদ্ভুত গণতন্ত্র! অ্যারিস্টটল বেঁচে থাকলেতিনিও এই গণতন্ত্রের রূপ দেখে অবাক হয়ে যেতেন। সেনাবাহিনী আর তাদেরবন্দুকের নলের মুখে কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে?
সাম্রাজ্যবাদীরাযেদিকে তাকায় সেদিকেই শুধু জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসবাদ দেখে। কিন্তু না, আমরাসন্ত্রাসী নই। আজ পৃথিবী জেগে উঠছে, সর্বত্র জাগরণের জোয়ার এসেছে। দেশেদেশে মানুষ জেগে উঠছে।
তারা নাকি শান্তি চায়! কিন্তু ইরাকে কী ঘটছে? লেবাননে কী হয়েছিল? কিংবা ফিলিস্তিনে? ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লাতিনআমেরিকায় কী চলছে? আর এখন তারা ভেনেজুয়েলাকে নতুন করে হুমকি দিচ্ছে। আমিবুঝতে পারি দক্ষিণের শোষিত দেশগুলোর জনগণ কী ভাবছে। আজকে মার্কিনসাম্রাজ্যবাদীদের বদলে যদি তাদের হাতে মাইক্রোফোন দিয়ে কিছু বলার সুযোগদেওয়া হতো, তবে তারা চিৎকার করে বলত, ‘নিজের রাস্তা দেখ, বিদেশিসাম্রাজ্যবাদীর দল।’
বন্ধুরা, আট বছর ধরে আমি প্রতিবছর এই হলে আসছি। গতবছরও আমরা সবাই এখানে সমবেত হয়েছিলাম। একটি ব্যাপার আমাদের সামনেপরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে। আমার মনে হয় না এই মুহূর্তে এখানে উপস্থিতকেউ যা ঘটে চলছে তার পক্ষে দাঁড়াতে পারবে। আসুন, সবাই সততার সঙ্গেবাস্তবতাকে স্বীকার করে নিই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে জাতিসংঘ গড়েউঠেছিল, তা ধসে গেছে, ভেঙে পড়েছে। এর আর কোনো মূল্য নেই।
হ্যাঁ, একটাভালো দিক এখনো আছে। জাতিসংঘ প্রতিবছর আমাদের একত্র করে, আমরা এখানে আসি, একজন আরেকজনের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলি, বিবৃতি দিই। যত ধরনের লম্বা লম্বাদলিল বানানো যায়, সেগুলো সব তৈরি করি। সুন্দর সুন্দর বক্তৃতা শুনি। অনেকরাষ্ট্রপ্রধান বক্তৃতা করেন, শুনতে ভালোই লাগে।
কিন্তু এই অধিবেশন এখনকার্যত একটি স্থবির জড় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আমাদের কোনো ক্ষমতা নেই, পৃথিবীজুড়ে যেসব ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চলছে তার বিরুদ্ধে আমাদের করার কিছুই নেই।তাই আজ, ২০ সেপ্টেম্বর, ভেনেজুয়েলা আবার প্রস্তাব করছে, জাতিসংঘ পুনর্গঠনকরা হোক।
গত বছর আমরা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবউত্থাপন করেছিলাম। বিভিন্ন দেশের প্রধান হিসেবে, রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিহিসেবে এসব প্রস্তাব নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। প্রথম প্রস্তাবটি ছিলজাতিসংঘের পরিষদগুলোর সম্প্র্রসারণ। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ীউভয় ধরনের সদস্য আরও বাড়াতে হবে। স্থায়ী সদস্য হিসেবে উন্নয়নশীল ও অনুন্নতদেশগুলোর প্রতিনিধিদেরও সুযোগ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বে ঘটে চলা সংঘাতনিরসনের জন্য স্বচ্ছতার সঙ্গে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। তৃতীয়ত, ভেটোপ্রথার নামে নিরাপত্তা পরিষদে এই অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, দমনমূলকপ্রক্রিয়া চালানো যাবে না। এই ভেটো ক্ষমতার বলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলিদেরলেবাবন ধ্বংস করায় মদদ দিয়েছে। আমরা নিঃশব্দে চেয়ে চেয়ে দেখেছি, নিরাপত্তাপরিষদ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এসব হতে দেওয়া চলবে না। চতুর্থত, মহাসচিবের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, তাঁকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।
গতকালমহাসচিব বাস্তবিক অর্থেই তাঁর বিদায়ী বক্তব্য দিলেন। তিনি স্বীকার করলেন, গত ১০ বছরে সবকিছু জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব জাতিসংঘের পতন আর যুক্তরাষ্ট্রেরএকচ্ছত্র আধিপত্যেরই পরিণতি।
তারপরও আমি বিশ্বাস করি, আশাবাদী হওয়ার মতোকারণ এখনো রয়েছে। যুদ্ধ আর ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে।নতুন চেতনার জন্ম হচ্ছে। তরুণ সমাজ নতুনভাবে, ভিন্ন পথে চিন্তা করছে। এখনআমাদের কাজ হলো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে নিজেদের দায়িত্ব পালন করা। ভোরেরসূর্য জেগে উঠছে। আফ্রিকা থেকে শুরু করে ওশেনিয়া পর্যন্ত সর্বত্রই তারআলোকচ্ছটা দেখা যাচ্ছে। এই নতুন আলোয় আমাদের জেগে উঠতে হবে। নিজেদেরশক্তিশালী করতে হবে, ইচ্ছাশক্তি ও চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। একটা নতুনপৃথিবী গড়ে তুলতে হবে।
আমরা সেই সব উদ্ভাবন চাই, যা এই পৃথিবীকেসাম্রাজ্যবাদীদের গ্রাস থেকে রক্ষা করবে। হয়তো এই শতকেই আমরা সেই শুভদিনদেখতে পাব, হয়তো আমাদের জীবদ্দশাতেই নতুন পৃথিবী দেখে যেতে পারব। এক নতুনজাতিসংঘ আমাদের সন্তান ও তাদের সন্তানদের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়েতুলবে। হয়তো আমাদের জাতিসংঘের সদর দপ্তর অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া উচিত, দক্ষিণের কোনো শহরে। আমরা এ জন্য ভেনেজুয়েলার নাম প্রস্তাব করেছি।
আপনারাজানেন, আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসককে বিমান থেকে নামতে দেওয়া হয়নি। আমারনিরাপত্তায় নিয়োজিত প্রধান ব্যক্তিকেও নয়। তাঁদের এই জাতিসংঘের সভায় আসারঅনুমতি দেওয়া হয়নি। এসবই প্রমাণ করে দেয় বৈষম্য কী, ক্ষমতার অপব্যবহার কাকেবলে। এখানে দাঁড়িয়ে আমি বারুদের গন্ধ পাই। কিন্তু তারপরও, ঈশ্বর আমাদেরসঙ্গে আছেন। তিনি সবার মঙ্গল করুন।
সূত্র: ওয়েবসাইট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার