বাঁশখালী : বাঁশখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মহাজন পাড়ার নিতান্ত সহজ, সরল গ্রাম্য গৃহবধূ নিপু সুশীল। বয়সের কোটা এখনও ত্রিশ পেরোয়নি। সৌদিআরবে চুল কাটার কাজ করা স্বামীর পাঠানো টাকায় তিন সন্তান নিয়ে তার ভালই দিন কেটে যাচ্ছিল।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর জামায়াত-শিবিরের বর্বরতায় নিপু সুশীল এখন পথের ভিখিরি। সহিংস তান্ডবের আগুনে মাথা গোঁজার ঠাঁই, সহায়-সম্বলের সঙ্গে পুড়ে গেছে একদিন আগে নিপু’র স্বামীর পাঠানো ৫০ হাজার টাকাও। পুড়ে গেছে অসময়ের সম্বল স্বর্ণের অলংকার, সন্তানদের পড়ার বইপত্র। সেইসঙ্গে পুড়েছে তার সোনালী স্বপ্নও।
জামায়াতের বর্বরতার নয় দিন পার হয়ে গেলেও এখনও ধ্বংসের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন নিপু সুশীলের মত পাখি বালা সুশীল, পলাশী শীলরা। মানুষরূপী জানোয়ারের নৃশংসতার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে পাখি বালা’র মৃত্যুর মুখে থাকা অবুঝ গাভীটিও, যার আরও দু’টি গাভী চরম যন্ত্রণা সয়ে ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে।
শুক্রবার দিনভর বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এসব এলাকার পাশাপাশি স্থানীয় আদালত, উপজেলা কমপ্লেক্স, মন্দির-মসজিদ, সবখানেই পাওয়া গেছে জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসের চিহ্ন। বাঁশখালী যেন পরিণত হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত কোন জনপদে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর বাঁশখালী জুড়ে তান্ডব সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির। বাঁশখালীকে দু’ভাগে ভাগ করে দক্ষিণ থেকে আসা জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা উপজেলা কমপ্লেক্স, আদালত এবং স্থানীয় মহাজন পাড়ায় আগুন দেয়। আর বাঁশখালীর উত্তরের জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে, টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে।
গুজবে বিভ্রান্তি, অত:পর তান্ডব
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত-শিবির মোবাইল ফোনে, উঠান বৈঠক করে এবং বিভিন্ন কৌশলে বেশকিছু গুজব ছড়িয়ে দেয়। এতে বাঁশখালীর অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধ্যুষিত বিএনপি সমর্থিত এলাকাগুলোতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
উপজেলার জলদি এলাকার দোকানদার সোলায়মান বাংলানিউজকে জানান, উপজেলার দক্ষিণে নাপোড়া, শেখেরখীল, বাংলাবাজার, টাইমবাজার, চাম্বল, গন্ডামারাসহ আরও কয়েকটি এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, সাঈদীর রায় ঘোষণার পর জনতা জেগে উঠেছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতের বর্ডার পার হয়ে যাচ্ছেন। তাকে ধরতে হবে। এজন্য সবাইকে জলদি উপজেলা সদরে আসার আহ্বান জানানো হয়। অন্যদিকে উপজেলার উত্তরে পুকুরিয়া, কালীপুর, বৈলছড়ি, মিয়াবাজার, চেচুরিয়াসহ আরও কয়েকটি এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, সাঈদীকে জলদি হাইস্কুল মাঠে ফাঁসি দেয়া হবে। এ ফাঁসি ঠেকানোর জন্য জনগণকে হাইস্কুল মাঠে আসার আহ্বান জানানো হয়।
এসব গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে বাঁশখালীর দু’টি কওমী-খারেজি মাদ্রাসা, একটি জামায়াত নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা এবং বিএনপির আধিপত্য আছে এমন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে উপজেলা সদরে তান্ডব শুরু করে। তান্ডবে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিল ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের ছেলে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘মূলত ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ যারা করেছে তারা সবাই শিশু-কিশোর। সবার বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর অথবা তার চেয়ে সামান্য কিছু বেশি হতে পারে। এদের মধ্যে এমন মোটিভ ছিল-যেন ভাংচুর করে, আগুন দিয়ে এরা উৎসব করছে।’
বর্বরতার সাক্ষী হয়ে আছে সরকারী অফিস-আদালত
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর দুপুর আড়াইটার মধ্যে বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে, টায়ার জ্বালিয়ে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা অবরোধ সৃষ্টি করে। মূলত ৩টা থেকে শুরু হয় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগসহ সহিংস তান্ডব।
জলদি পৌরসদরের বাসিন্দা ও দোকানদার লিয়াকত বাংলানিউজকে জানান, হরতালের কারণে জলদিসহ পুরো এলাকায় সকাল থেকেই অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল। রায় ঘোষণার পর দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তাঘাটে লোকজন একেবারে কমে গিয়ে পুরো এলাকা ভুতুড়ে জনপদে পরিণত হয়। এর মধ্যে ৩টার দিকে জামায়াত-শিবিরের লোকজন ছোট ছোট বাচ্চাদের এনে বাজারে হিন্দুদের বিভিন্ন দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেক দোকান বন্ধ থাকলেও সেগুলো ভেঙ্গে লুটপাট করা হয়। জিনিসপত্র তছনছ করে দোকানগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কয়েক হাজার লোক যাদের অধিকাংশ শিশু-কিশোর, তারা মিছিল করে এসে প্রথমে উপজেলা শিক্ষা অফিস, কৃষি, এলজিইডি, উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় এবং উপজেলার সরকারী ত্রাণের গুদামে আগুন দেয়। ভাংচুর করা হয় ইউএনও’র অফিস। আগুনে গুদামে রাখা প্রায় দু’হাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন বইপত্র, পুরনো সিলেবাসের প্রায় এক লক্ষ বইপত্র, ত্রাণের কম্বল, টিন, কৃষি উপকরণ, জেনারেটর সম্পূর্ণভাবে পুড়ে গেছে। তাদের দেয়া আগুন ছড়িয়ে পড়ে উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকা মসজিদেও।
শুক্রবার উপজেলা কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে, গুদামের ভেতর পুড়ে যাওয়া বইপত্র-মালামাল থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে।
বাঁশখালী সিনিয়র সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জারিকারক ইমাম হোসেন বাংলানিউজকে জানান, হরতালের কারণে সিনিয়র সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট আমিরুল ইসলাম এবং সিনিয়র সহকারী জজ রোকেয়া আক্তার এজলাসে বসেননি। কিন্তু দু’বিচারকই আদালতে ছিলেন। বিকেল ৫টার দিকে হাজার হাজার মানুষ যাদের অধিকাংশই শিশু-কিশোর, তারা মিছিল করে আদালত এলাকার ভেতরে ঢুকতে শুরু করে। মুহুর্তের মধ্যেই তারা দু’টি আদালতের এজলাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। কোর্ট হাজত ভেঙ্গে দু’জন আসামীকে বের করে দেয়।
বাঁশখালী আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম তোফাইল বিন্ হোছাইন বাংলানিউজকে বলেন, ‘সেদিনের ঘটনা কতটা নৃশংস তা বলে বোঝানো যাবেনা। জামায়াত-শিবির কতটা বর্বর হতে পারে তা চোখে না দেখলে বোঝা যাবেনা। মনে হচ্ছিল আরেকটা একাত্তর ফিরে এসেছে। আদালতের সব নথিপত্র তারা পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ক্ষতি আগামী এক’শ বছরেও কাটিয়ে উঠা যাবেনা।’
উপজেলা কমপ্লেক্স এবং আদালত ভবনে তান্ডবের পর জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা টিএন্ডটি অফিস ভাংচুর করে। ওই অফিসের সামনে থাকা বেশ কয়েকটি দোকানও আগুনে পুড়িয়ে দেয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় শ্রী শ্রী অদ্বৈতানন্দ ঋষিমঠ ও মিশনসহ চারটি হিন্দু মন্দির।
নি:স্তব্ধ মৃত্যুপুরী মহাজন পাড়া
শুক্রবার দুপুর দু’টার দিকে বাঁশখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মহাজন পাড়ায় ঢুকতেই দেখা গেল, শুয়ে আছে একটি সবল গাভি, চোখ জোড়া আকাশের দিকে। মনে হল চোখ খুলে বিশ্রাম নিচ্ছে গাভীটি। কিন্তু গাভীটির মাথার উপর কাকের অবিরমা কা, কা শব্দ আর পাখি বালার কান্নার পর বোঝা গেল, না, গাভিটি আর জীবিত নেই। জামায়াতের নৃশংসতার শিকার হয়ে আগুনে পুড়ে টানা আটদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শুক্রবার ভোরে গাভিটি মারা গেছে।
পাখি বালা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানালেন, তার আরও একটি গাভী আগুনে পুড়ে তাৎক্ষণিকভাবে মারা গেছে। আরও একটি পোড়া গাভি গত আটদিন ধরে কিছু খেতে পারছেনা।
পাখি বালার ছোট ছেলের শ্বশুর দয়াল হরিকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে খুন করেছিল জামায়াতের দুর্বৃত্তরা। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে চার ভাই পুলিন সুশীল, সুনীল সুশীল, দুলাল সুশীল, আশীষ সুশীল এবং অপর দু’ভাই স্বপন শীল ও সম্ভু শীল এবং পাখি বালা শীলের বাড়ি।
দুলালের স্ত্রী নিপু সুশীল বাংলানিউজকে জানান, আগুনের হাত থেকে একটি পরণের কাপড়ও বাঁচাতে পারেননি নিপু। স্বামীর পাঠানো ৫০ হাজার টাকা, নিজের কাছে থাকা ৫ হাজার টাকা, প্রায় ১৪ ভরি স্বর্ণালংকার, বিদেশি কম্বল-সবকিছু পুড়ে গেছে।
পুরো পাড়ায় এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পোড়া খড়ের গাদা, পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরগুলো, জিনিসপত্র। আর আছে হারানোর অব্যক্ত শোক। পাখি বালা, নিপু সুশীলরা এখনও বুঝতে পারছেন না, তাদের দোষটুকু কোথায়, কেনই-বা তাদের ঘরে আগুন। তারা বুঝতে পারছেন না, মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসা দয়াল হরির কি দোষ ছিল কিংবা কি অপরাধ করেছিল অবুঝ গাভীগুলো।
মার্চ ০৯,২০১৩