স্পোর্টস ডেস্ক: সোহাগ গাজী আশায় বসতি গড়তে চাইলেন, ‘ক্রিকেট খেলাটা এমন যে আজ ওরা রাজত্ব করেছে, কালকের দিনটি আমাদেরও হতে পারে।’
তা তো পারেই। ক্রিকেটে কত কিছুই তো হয়! তবে আপাতত গলে নেমে আসা সন্ধ্যার সঙ্গে এই টেস্টে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের বড় মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। বিতর্কের সাগর পাড়ি দিয়ে আসা শ্রীলঙ্কা দল, নবীন অধিনায়কের তরুণ শ্রীলঙ্কা দল প্রথম দিনেই যেন ম্যাচের ভাগ্য লিখে দিল।
প্রথম দিনের খেলা শেষে শ্রীলঙ্কা দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে এলেন কুমার সাঙ্গাকারা। ২০০৭ সালে সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা সফরের বাংলাদেশ দলের সঙ্গে এই দলের কী পার্থক্য দেখলেন—এ প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন। বললেন ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপট থেকে দুই সিরিজের পার্থক্যটা, ‘ওই সিরিজটা আমি পেছনে প্রচুর রান নিয়ে শুরু করেছিলাম। আর এবার খেলছি দুই মাসেরও বেশি খেলার বাইরে থেকে।’
সেবার প্রথম টেস্টে ৬ রানে আউট হয়েছিলেন। পরের দুই টেস্টে বাংলাদেশের বোলাররা আর তাঁকে আউট করতে পারেননি। করেছিলেন ২০০ ও ২২২! প্রথম টেস্টে শ্রীলঙ্কান ইনিংসে চারটি সেঞ্চুরি ছিল। চার সেঞ্চুরিয়ানের মধ্যে বিস্ময়কর একটা নামও ছিল—চামিন্ডা ভাস। দ্বিতীয় টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করার পর সাঙ্গাকারা এর চেয়েও বিস্ময়কর একটা তথ্য উপহার দিয়েছিলেন। ভাস কীভাবে খেলেছে—এটা দেখে নাকি তিনি অনেক কিছু শিখেছেন!
শ্রীলঙ্কার এই দলে সাঙ্গাকারার সেই সুযোগ নেই।মিডল-অর্ডারে মাহেলা জয়াবর্ধনে নেই, থিলান সামারাবীরা নেই। তরুণ ব্যাটসম্যানদের শেখানোর দায়িত্বটা পুরোপুরিই তাঁর কাঁধে। তা শেখালেনও। সেই ডিসেম্বরের শেষে মেলবোর্ন টেস্টে আঙুল ভাঙার পর কালই প্রথম ম্যাচ খেললেন।মাতারায় বাংলাদেশের বিপক্ষে তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচটা খেলতে চেয়েছিলেন।ম্যাচের আগের রাতে পৌঁছেও গিয়েছিলেন মাতারায়। চুক্তি নিয়ে জটিলতায় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট (এসএলসি) অপমানজনকভাবে তাঁকে ফিরে আসতে বলে। সুনীল গাভাস্কারের টেস্ট রানকে পেরিয়ে যাওয়া ৩১তম টেস্ট সেঞ্চুরিতে ম্যাচ প্র্যাকটিসবিহীন এই সাঙ্গাকারাই বাংলাদেশকে ঠেলে দিলেন নিরাশার আঁধারে।
টেস্ট ক্রিকেটে এমন দিনের সঙ্গে অনেকবারই পরিচয় হয়েছে বাংলাদেশের। তবে টেস্ট ম্যাচ শুরুর সকালে কাল যে পরিস্থিতি, সেটি বোধ হয় নতুন। হোটেল থেকে মাঠে রওনা দেওয়ার সময়ও নিশ্চিত নয়, কোন ১১ জন খেলবে!
তামিম ইকবালকে না পাওয়াটা অবশ্য ততক্ষণে মোটামুটি নিশ্চিত। আগের দিন অস্ট্রেলিয়ান শল্যবিদ ডেভিড ইয়াং শেষ চেষ্টা হিসেবে বাঁ হাতের কবজিতে কর্টিসোন ইনজেকশন দিয়েছিলেন। তাতেও কাজ হয়নি। সকালেও ব্যথা অনুভব করেছেন। এতটাই যে, ২০১০ ইংল্যান্ড সফরের স্মৃতিও ‘যা হয় হবে, খেলে ফেলি’ সিদ্ধান্ত নিতে দেয়নি।সেবার ইংল্যান্ডেও এমন হাতের চোট নিয়ে খেলে দুই টেস্টেই সেঞ্চুরি করেছিলেন।ঘটনাচক্রে ওল্ড ট্রাফোর্ডে দ্বিতীয় টেস্টের সেঞ্চুরিটাই হয়ে আছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তামিমের সর্বশেষ সেঞ্চুরি।
তামিম অনেক দিনই দলে ‘অটোমেটিক চয়েস’। পেসারদের মধ্যে রুবেল হোসেনও তা-ই। তিনিও নেই। পরশু সকালে পিঠের ব্যথা নিয়ে ঘুম ভেঙেছে। সেদিন বিশ্রাম দিয়েও কোনো ফল হয়নি। সকালে মাঠে ফিটনেস টেস্টে উতরাতে ব্যর্থ। তামিম না থাকায় এনামুল ও মমিনুল দুই ব্যাটসম্যানের অভিষেকই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছিল দুই পেসারের মধ্যে—শাহাদাত, না রবিউল?
রবিউলকে নিলে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের মিলিত অভিজ্ঞতা হয়ে যায় ৯ টেস্টের! শাহাদাতের ৩৪ টেস্টের অভিজ্ঞতাই তাই বেছে নেওয়া হলো। সেই অভিজ্ঞতার কোনো সুফল অবশ্য পাওয়া গেল না। বিপিএলের সময় শন টেইট এক জোড়া বুট দিয়ে গেছেন। সেটি পেয়ে উজ্জীবিত শাহাদাত টেস্টে গতির ঝড় তুলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু গতি তো আর শুধু বুটে আসে না। ১৩৮-১৩৯ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুঁলেন শুরুতে। শেষ দিকে যা নেমে এল ১৩০-এর নিচে। সারা দিনে উইকেট নিতে পারেন, এমন বল একটি কি দুটি!
নতুন বলে শাহাদাত ও আবুল হাসানের বোলিংয়ের সময় টেলিভিশনে দুজনের ক্যারিয়ার রেকর্ড দেখাচ্ছিল। একজনের বোলিং অ্যাভারেজ টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মতো, অন্যজনের কোনো অ্যাভারেজই নেই! আবুল হাসান টেস্ট অভিষেকে ১০ নম্বরে নেমে সেঞ্চুরি করে ফেললেও এখনো যে টেস্ট উইকেটের দেখা পাননি।
উইকেট না পেলেন, রানটা তো আটকে রাখা যায়। সেটিতেও ব্যর্থ শাহাদাত-হাসানরা। প্রথম দুই সেশন শেষে রানরেট ছিল সাড়ে চারের ওপরে। দিন শেষে একটু নেমে এসেছে, তার পরও সেটি ৪.২২!
একমাত্র যাঁর বোলিং দেখে উইকেট নিতে পারেন বলে মনে হয়েছে, দিনের তিনটি উইকেটই সেই সোহাগ গাজীর। স্পেশালিস্ট বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে মিতব্যয়ীও তিনিই। মাত্র তৃতীয় টেস্টেই সোহাগ হয়ে গেছেন বাংলাদেশের বোলিং-ভরসা। এই অফ স্পিনারের জন্য বড় স্বীকৃতি, তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য খুশি হওয়ার মতো তথ্য নয়।
সাঙ্গাকারার উইকেটটি শেষ পর্যন্ত সোহাগই পেয়েছেন। না পেলে সেটি বড় দুঃখের কারণ হতো। একবার ফ্লাইটে বোকা বানিয়েও সাঙ্গাকারাকে অল্পের জন্য স্টাম্পিং করতে পারেননি। আরেকবার আম্পায়ারের ভুলে বঞ্চিত হয়েছেন এলবিডব্লু পাওয়া থেকে। তখন ৩৮ রানে থাকা সাঙ্গাকারা পরের সুযোগটা দিলেন ১১১ রানে। সেটিও সোহাগের বলেই। কিন্তু মিড অনে ক্যাচ ফেলে দিলেন আশরাফুল।
টেস্টে যাঁর ৮টি ডাবল সেঞ্চুরি, সেই সাঙ্গাকারাকে ১৪২ রানে ফেরাতে পারাটাও অবশ্য বড় স্বস্তি। গলের প্রথম দিনে বাংলাদেশের তৃপ্তির জায়গা এটুকুই!
৯ মার্চ/নিউজরুম