হুমায়ূন আহমেদকে কাছ থেকে দেখিনি কখনো। তবু তাঁর গল্প-উপন্যাস পড়ে আর নাটক দেখে মনের গহিনে বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তির সঙ্গে গড়ে তুলেছিলাম এক অলৌকিক যোগাযোগ। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা গিয়েছিলাম। কানাডায় ফিরে আসি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। সঙ্গে কবি ইকবাল হাসান। জানালেন, টরন্টো পৌঁছেই তিনি নিউইয়র্ক যাবেন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে। উদ্দেশ্য, হুমায়ূন আহমেদকে উৎসর্গ করা তাঁর ও সমকাল-এর সম্পাদক গোলাম সারোয়ারের বই পৌঁছে দেওয়া।
হুমায়ূন আহমেদ তখন নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন। ইচ্ছে করলেই দেখা করা সম্ভব নয়। তাই ইকবাল হাসানের সঙ্গে যাওয়ার সুযোগটি ছাড়লাম না। হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎ পেতে মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহার স্ত্রী রুমা সাহা সর্বাত্মক সহযোগিতা করলেন। জানা গেল, তিনি কেমো নিচ্ছেন হাসপাতালে। তিনি যেদিন কেমো নেন, সাধারণত সেদিন হাসপাতালে থেকে পরদিন বাসায় ফেরেন। তবে আমরা সন্ধ্যার দিকে কিছুক্ষণের জন্য হাসপাতালে গিয়ে দেখা করতে পারি।
বেলভিউ হাসপাতাল। কেবিনে বিছানায় আধশোয়া হুমায়ূন আহমেদ। পাশের চেয়ারে স্ত্রী শাওন।মাঝখানে দাবার কোটে নিমগ্ন তাঁর চোখ। একপাশে ল্যাপটপ। কোনো উত্তেজনা নেই।চোখমুখে নেই কষ্টের কোনো ছাপ বা ব্যথার কাতরতা। কেমোর কারণে চেহারায় কালো দাগ পড়েছে। এদিক-ওদিক নল, গায়ে হাসপাতালের গাউন।
ইকবাল হাসানকে দেখে খুশি হলেন। একটু উঠে বসে বিছানা দেখিয়ে বললেন, ইকবাল আসো, এখানে বসো। রুমা আর আমি একটু দূরে চেয়ারে বসলাম। কত কথা! কথার মাঝখানে কৌতুক, কারও কারও সমালোচনা, হাসাহাসি। সন্ধ্যাটি বদলে গেল এক আশ্চর্য ঘরোয়া আড্ডায়। মূল কথক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি অসম্ভব প্রাণোজ্জ্বল, যেন কোনো কষ্টই স্পর্শ করছে না।হঠাৎ প্রশ্ন, চা খাবে তোমরা? বলেই হেসে উঠে বললেন, ও আচ্ছা, এখানে চা খাওয়াব কীভাবে? তার চেয়ে বরং কবির আগমন উপলক্ষে একটা কবিতা পড়ে শোনাই।তারপর শাওনের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বলো?
হলুদ খামে ভরা কবিতাটি পাশেই রাখা ছিল। হাসপাতালের কেবিনে বসেও যে তিনি লেখালেখি করেন, সে গল্পও শোনালেন। একদিন মগ্ন হয়ে লিখতে লিখতে অঝোর ধারায় কাঁদছেন। এক বিদেশি হঠাৎ তাঁর কেবিনে এসে হতবাক। প্রশ্ন করলেন, তুমি কাঁদছ কেন? তিনি বললেন, আই উইশ টু বি অ্যান অথার ইন মাই কান্ট্রি। আমি আমার চরিত্রদের খুব ভালোবাসি। ওদের দুঃখে আমি কাঁদি।
এরপর হলুদ খামের ভেতর থেকে বের করে আনলেন কাগজটি। বললেন, এটি আসলে একটি গান। ইচ্ছা আছে, সত্য সাহার ছেলেকে দিয়ে সুর করাব।
হুমায়ূন আহমেদ পড়ে শোনালেন মাকে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতাটি। পুরো দৃশ্যটি আমি ভিডিও করলাম। আজ হঠাৎ এত দিন পর সেই ভিডিও দেখে মনে হচ্ছে, ‘বেদনা কী ভাষায় রে মর্মে মর্মরি গুঞ্জরি বাজে।’