রং-এর খেলা

0
162
Print Friendly, PDF & Email

৮ মার্চ, ২০১৩, গ-বিভাগ: দ্বিতীয়
কালো-ধূসর কালো, গাঢ় কালো কিংবা আবছায়া কালো! আমার জগতের রং এগুলোকালোর মাঝেই আমাকে খুঁজতে হয়েছে রংধনুর সাত রঙের সব আভাকেতাই আঁধারই আমার যত সাজানো বর্ণালিদুঃখের নীল রং আমার কাছে নিকষ কালো; আর সুখানুভূতিগুলো আবছায়াময়, অনেক কোমল
আমি মৌনতা; অন্ধ-জন্মান্ধ, বয়স ১৫ বছরজানি না তোমাদের জামার রং কী, বারান্দায় টবে ফোটা মিষ্টি গন্ধের ফুলেরই বা কী রংজানি না জানালার ওপরে বাসা বাঁধা পাখিটার পালকে কোন রঙের কারুকাজ কিংবা শায়ের মানচিত্রটি কোন রঙের আঁকিবুঁকি
আমার অনেক জানতে ইচ্ছে করত এসবকিন্তু এখন আর করে না; মনে হয় আমার বিবশ কৌতূহলগুলোও অন্ধকারে ডুবে গেছে! এক দিনে তো না, দিনে দিনেই ডুবেছে-ভেসেছে, ভেসেছে-ডুবেছেডুবতে তাকে হয়েছে; না চাইলেও…
আমার জগটা অনেক ছোটপরিজন আর বন্ধু নিতান্তই কমঅবশ্য এতে লাভ হলো, আমার কোনো শত্রু নেইনাহ্, ভুল বললাম; আছে তো, জন্ম থেকেই তো আঁধারের সঙ্গে শত্রুতামি করে আসছি! আচ্ছা, বাদ দিই এসব প্যাঁচালশুধু শুধুই বকে যাচ্ছিবরং আমার বন্ধুদের কথা বলি এখনওরা সবাই অনেক ভালোতাই ওদের কথা বলতে আমারও বেশ লাগেআমাদের পরিবারে আমরা তিনজনবাবা, মা আর আমিআমার বয়স যখন চার বছর, তখন ব্রেন টিউমারে বাবা মারা যানতাঁর ফেলে রাখা স্মৃতিগুলো আর মায়ের কাছে শোনা অসংখ্য গল্পই সৃষ্টি করেছে এক অদৃশ্য অস্তিত্বতাই না থেকেও বাবা আছেন আমাদের মাঝে পরিবারের এক অনন্ত অবিচ্ছেদ্য সত্তা হয়েমাআমার জগতের এক বড় অংশজুড়েই তিনিমা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকাস্কুলের বাইরে পুরোটা সময়জুড়েই তিনি আমার সাথিসুখ-দুঃখের, স্বপ্ন-সাধের
যখন ছোট ছিলাম, তখন মায়ের সঙ্গেই স্কুলে যেতাম আর চুপটি করে বসে থাকতাম তাঁর পাশেক্লাসে যখন কবিতা কিংবা গল্প পড়ানো হতো, তখন আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতামঅদ্ভুত এক আনন্দ লাগত! কিন্তু এখন আর যাওয়া হয় নাবড় হয়ে গেছি কিনা, তাইআমার জন্য মাকে তো আর কম ঠাট্টা-পরিহাস-কটূক্তি শুনতে হয়নি নিয়ত, প্রতিনিয়তই!
আমরা মফস্বলে থাকিআধুনিকতায় বাড়ন্ত না হলেও জীবন শম্বুকগতিতে ঠিকই চলে যায়ও হ্যাঁ, আমি কিন্তু পড়তে পারিঅবশ্য তোমাদের মতো নাএটা স্পর্শ আর অনুভবের শিক্ষণব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ামা-ই শিখিয়েছেন অনেক ত্যাগ স্বীকার করেতবে সমস্যা হলো, ব্রেইল পদ্ধতির বই কিংবা স্কুল আমাদের এই মফস্বলে নেইমা মাঝে মাঝেই পরিচিত কাউকে দিয়ে বড় শহর থকে ব্রেইল পদ্ধতির কিছু বই নিয়ে আসেনপ্রতিটি বইয়ের অক্ষরের স্পর্শ আমার চেনাওদের অনেক আপন মনে হয়আমার ঘরের খাটের মাথার দিকে একটা শেলফে সেগুলো রাখাশেলফের পাশেই রাখা একটা কাঠের বড় বাক্সআমার জাদুর বাক্স! জাদুর বাক্সের কথা তো বলাই হয়নিওটা কাকু দিয়েছিলেনকাকু মেরিন ইঞ্জিনিয়ার; জাহাজে করে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানআর যখন ছুটিতে আমাদের বাসায় আসেন, তখন মজার মজার সব গল্প করেনআমি আবছায়া আঁধারে সেগুলোকে সাজিয়ে নিই নিজের মতন করেআমার যখন আট বছর বয়স, তখন কাকু একবার বেড়াতে এলেন লম্বা ছুটিতেসাথে অনেক দেশের অনেক গল্পসেবার কাকু বলেছিলেন যে গ্রিসে একটা ঝরনা আছে, যেখানে চোখ বন্ধ করে কয়েন ফেলে কোনো কিছু চাইলে সেই চাওয়া নাকি পূরণ হয়আমি তখন বায়না ধরেছিলাম যে আমিও সেখানে কয়েন ফেলবকাকু বুঝিয়েছিলেন, তুমি বড় হও, আর অনেক কয়েন জোগাড় করোতারপর আমি তোমাকে নিয়ে যাব আর তুমি সব কয়েন একে একে ওই ঝরনার পানিতে ফেলোতাহলে তত দিনে তোমার যত ইচ্ছা আর চাওয়া জমা হবে, সব একবারে পূরণ হয়ে যাবেতার পরদিনই তিনি আমাকে এই জাদুর বাক্সটি এনে দেন কয়েন জমানোর জন্যআর সেই ছোট্টটি থেকে আমি কয়েন ফেলে যাচ্ছি এই জাদুর বাক্সেএখন হয়তো বুঝি যে কাকুর সেদিনের সেই কথাগুলো ছিল শুধুই মন-ভোলানো আর আমাকে শান্ত করার জন্যকিন্তু তার পরও এই অভ্যাসটা আমার রয়ে গেছেকয়েন ফেলি আর ভাবি, একদিন হয়তো আমি ওই ঝরনায় সব কয়েন ফেলব আর পরদিনই ঘুম থেকে উঠে দেখব, এত দিনের একটিমাত্র স্বার্থপর ইচ্ছাই আমার পূরণ হয়েছে, আর আমি ভেসে যাচ্ছি আলোর বন্যায়, চোখ ঝলসে যাচ্ছে সাত রঙের বিচ্ছুরণে
ধ্যা, কী সব বলে চলেছি সেই তখন থেকেআমার আর একজন বন্ধু আছেওর নাম টুকু, বয়স ছয় কি সাতআমাদের বাসার পাশেই কোনো এক বস্তিতেই ও থাকেওর বাবা রিকশা চালান আর মা আমাদের বাসায় কাজ করেনআমার মা যখন স্কুলে চলে যান, তখন আমার অনেকটা সময় কাটে টুকুর সাথে গল্প করেওর বাঁদরামির ফিরিস্তি শুনতে আমার বেশ লাগেএরাই আমার সারা বেলা, দিনরাত্রির সাতকাহনের অংশীদার
দিন যায়, দিন আসে নিস্তরঙ্গভাবেএরই মাঝে হঠা একদিন সারা বেলা টুকুর কোনো সাড়াশব্দ পাই নাওর মাকে ডেকে বলি, ‘খালা, টুকু কোথায়? অসুস্থ নাকি ও?’ খালা বলেন, ‘ওরে গলির কাছে একটা চায়ের দোকানে কামে লাগাইয়া দিছিকাপ-টাপ ধুইব আরকিসারা দিন টো-টো কইরা ঘুইরা বেড়ায়, কুনো কামকাজ করে নাএর থাইকা ওইখানে থাকলে ওর সময়ডা ভালো যাইব আর দুইডা পয়সাও পামুআমি শুনে আকাশ থেকে পড়ি! বলি, ‘এত পিচ্চি ছেলে কীভাবে কাজ করবে? ওর তো এখন ছোটাছুটি করারই বয়সএর থেকে আপনি ওকে স্কুলে দিতে পারতেন
খালা বলেন, ‘গরিবের পোলা, পড়ালেখা শিইখা কী করব? তা ছাড়া আমাগো কাছে তো আর জাদুর চেরাগ নাই যে যা চামু তাই পামু, আর পোলাডারে নতুন জামা-কাপড় পিইন্দা চক-সেলেট হাতে ধরাইয়া স্কুলে পাডামু
জাদুর চেরাগ! শব্দটা আমার কানে বাজেআচ্ছা, আমার কাছে তো একটা জাদুর বাক্স আছেএত দিনে নিশ্চয়ই অনেক কয়েন জমেছেওখান থেকে দিলেই তো মনে হয় টুকুর প্রাথমিক স্কুলের খরচটা মিটে যাবে
বেশ উত্তেজনা কাজ করতে থাকে আমার ভেতরখালাকে কিছু না বলে অপেক্ষা করতে থাকি কখন মা আসবেন তার জন্যবিকেলে ফেরার সাথে সাথেই আমি টুকু আর জাদুর বাক্স নিয়ে মাকে বলি আমার ভাবনার কথা
মা সাগ্রহেই তা মেনে নেন আর আশ্বাস দেন খালার সাথে কথা বলে সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেওয়ার
বেশ কিছুদিন পর…
টুকুর সাথে আমার আড্ডা যথারীতি জমে উঠেছে আবারমা বলেন, ‘ও এখন রোজ স্কুলে যায়নতুন চকচকে স্কুলড্রেস পরে; হাতে চক, স্লেট আর হরেক রকমের রংবেরঙের বই নিয়েইদানীং ওর পাকামো যেন আরও বেড়েছেও স্কুলে প্রতিদিন কী কী বাঁদরামি করে, তার ফিরিস্তি আমার কাছে দেওয়া চাই-ই চাইআমি শুনি আর হাসিআমার এত দিনের স্বার্থপর চাওয়াটা তো কোনো প্রকারে পূরণ হলোনিজে আলোর দেখা নাই বা পেলাম, ওই পিচ্চিটাকে তো একটা আলোর সন্ধান দিতে পারলামআবছায়া আঁধারের মাঝে শিক্ষার এই আলোটুকুই হয়তো খুঁজে দেবে ওর ভবিষ্যতের পথের দিশাএটাই কি কম প্রাপ্তি…!
 শৈলকুপা পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ঝিনাইদহl

 

শেয়ার করুন