৮ মার্চ, ২০১৩, গ-বিভাগ: দ্বিতীয়
কালো-ধূসর কালো, গাঢ় কালো কিংবা আবছায়া কালো! আমার জগতের রং এগুলো। কালোর মাঝেই আমাকে খুঁজতে হয়েছে রংধনুর সাত রঙের সব আভাকে। তাই আঁধারই আমার যত সাজানো বর্ণালি। দুঃখের নীল রং আমার কাছে নিকষ কালো; আর সুখানুভূতিগুলো আবছায়াময়, অনেক কোমল।
আমি মৌনতা; অন্ধ-জন্মান্ধ, বয়স ১৫ বছর। জানি না তোমাদের জামার রং কী, বারান্দায় টবে ফোটা মিষ্টি গন্ধের ফুলেরই বা কী রং। জানি না জানালার ওপরে বাসা বাঁধা পাখিটার পালকে কোন রঙের কারুকাজ কিংবা শায়ের মানচিত্রটি কোন রঙের আঁকিবুঁকি।
আমার অনেক জানতে ইচ্ছে করত এসব। কিন্তু এখন আর করে না; মনে হয় আমার বিবশ কৌতূহলগুলোও অন্ধকারে ডুবে গেছে! এক দিনে তো না, দিনে দিনেই ডুবেছে-ভেসেছে, ভেসেছে-ডুবেছে। ডুবতে তাকে হয়েছে; না চাইলেও…
আমার জগৎটা অনেক ছোট। পরিজন আর বন্ধু নিতান্তই কম। অবশ্য এতে লাভ হলো, আমার কোনো শত্রু নেই। নাহ্, ভুল বললাম; আছে তো, জন্ম থেকেই তো আঁধারের সঙ্গে শত্রুতামি করে আসছি! আচ্ছা, বাদ দিই এসব প্যাঁচাল। শুধু শুধুই বকে যাচ্ছি। বরং আমার বন্ধুদের কথা বলি এখন। ওরা সবাই অনেক ভালো। তাই ওদের কথা বলতে আমারও বেশ লাগে। আমাদের পরিবারে আমরা তিনজন। বাবা, মা আর আমি। আমার বয়স যখন চার বছর, তখন ব্রেন টিউমারে বাবা মারা যান। তাঁর ফেলে রাখা স্মৃতিগুলো আর মায়ের কাছে শোনা অসংখ্য গল্পই সৃষ্টি করেছে এক অদৃশ্য অস্তিত্ব। তাই না থেকেও বাবা আছেন আমাদের মাঝে পরিবারের এক অনন্ত অবিচ্ছেদ্য সত্তা হয়ে। মা—আমার জগতের এক বড় অংশজুড়েই তিনি। মা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। স্কুলের বাইরে পুরোটা সময়জুড়েই তিনি আমার সাথি—সুখ-দুঃখের, স্বপ্ন-সাধের।
যখন ছোট ছিলাম, তখন মায়ের সঙ্গেই স্কুলে যেতাম আর চুপটি করে বসে থাকতাম তাঁর পাশে। ক্লাসে যখন কবিতা কিংবা গল্প পড়ানো হতো, তখন আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। অদ্ভুত এক আনন্দ লাগত! কিন্তু এখন আর যাওয়া হয় না। বড় হয়ে গেছি কিনা, তাই। আমার জন্য মাকে তো আর কম ঠাট্টা-পরিহাস-কটূক্তি শুনতে হয়নি নিয়ত, প্রতিনিয়তই!
আমরা মফস্বলে থাকি। আধুনিকতায় বাড়ন্ত না হলেও জীবন শম্বুকগতিতে ঠিকই চলে যায়। ও হ্যাঁ, আমি কিন্তু পড়তে পারি। অবশ্য তোমাদের মতো না। এটা স্পর্শ আর অনুভবের শিক্ষণ—ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়া। মা-ই শিখিয়েছেন অনেক ত্যাগ স্বীকার করে। তবে সমস্যা হলো, ব্রেইল পদ্ধতির বই কিংবা স্কুল আমাদের এই মফস্বলে নেই। মা মাঝে মাঝেই পরিচিত কাউকে দিয়ে বড় শহর থকে ব্রেইল পদ্ধতির কিছু বই নিয়ে আসেন।প্রতিটি বইয়ের অক্ষরের স্পর্শ আমার চেনা—ওদের অনেক আপন মনে হয়। আমার ঘরের খাটের মাথার দিকে একটা শেলফে সেগুলো রাখা। শেলফের পাশেই রাখা একটা কাঠের বড় বাক্স—আমার জাদুর বাক্স! জাদুর বাক্সের কথা তো বলাই হয়নি। ওটা কাকু দিয়েছিলেন। কাকু মেরিন ইঞ্জিনিয়ার; জাহাজে করে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান। আর যখন ছুটিতে আমাদের বাসায় আসেন, তখন মজার মজার সব গল্প করেন। আমি আবছায়া আঁধারে সেগুলোকে সাজিয়ে নিই নিজের মতন করে। আমার যখন আট বছর বয়স, তখন কাকু একবার বেড়াতে এলেন লম্বা ছুটিতে। সাথে অনেক দেশের অনেক গল্প। সেবার কাকু বলেছিলেন যে গ্রিসে একটা ঝরনা আছে, যেখানে চোখ বন্ধ করে কয়েন ফেলে কোনো কিছু চাইলে সেই চাওয়া নাকি পূরণ হয়। আমি তখন বায়না ধরেছিলাম যে আমিও সেখানে কয়েন ফেলব। কাকু বুঝিয়েছিলেন, তুমি বড় হও, আর অনেক কয়েন জোগাড় করো। তারপর আমি তোমাকে নিয়ে যাব আর তুমি সব কয়েন একে একে ওই ঝরনার পানিতে ফেলো। তাহলে তত দিনে তোমার যত ইচ্ছা আর চাওয়া জমা হবে, সব একবারে পূরণ হয়ে যাবে। তার পরদিনই তিনি আমাকে এই জাদুর বাক্সটি এনে দেন কয়েন জমানোর জন্য। আর সেই ছোট্টটি থেকে আমি কয়েন ফেলে যাচ্ছি এই জাদুর বাক্সে। এখন হয়তো বুঝি যে কাকুর সেদিনের সেই কথাগুলো ছিল শুধুই মন-ভোলানো আর আমাকে শান্ত করার জন্য।কিন্তু তার পরও এই অভ্যাসটা আমার রয়ে গেছে। কয়েন ফেলি আর ভাবি, একদিন হয়তো আমি ওই ঝরনায় সব কয়েন ফেলব আর পরদিনই ঘুম থেকে উঠে দেখব, এত দিনের একটিমাত্র স্বার্থপর ইচ্ছাই আমার পূরণ হয়েছে, আর আমি ভেসে যাচ্ছি আলোর বন্যায়, চোখ ঝলসে যাচ্ছে সাত রঙের বিচ্ছুরণে।
ধ্যাৎ, কী সব বলে চলেছি সেই তখন থেকে। আমার আর একজন বন্ধু আছে। ওর নাম টুকু, বয়স ছয় কি সাত। আমাদের বাসার পাশেই কোনো এক বস্তিতেই ও থাকে। ওর বাবা রিকশা চালান আর মা আমাদের বাসায় কাজ করেন। আমার মা যখন স্কুলে চলে যান, তখন আমার অনেকটা সময় কাটে টুকুর সাথে গল্প করে। ওর বাঁদরামির ফিরিস্তি শুনতে আমার বেশ লাগে। এরাই আমার সারা বেলা, দিনরাত্রির সাতকাহনের অংশীদার।
দিন যায়, দিন আসে নিস্তরঙ্গভাবে। এরই মাঝে হঠাৎ একদিন সারা বেলা টুকুর কোনো সাড়াশব্দ পাই না।ওর মাকে ডেকে বলি, ‘খালা, টুকু কোথায়? অসুস্থ নাকি ও?’ খালা বলেন, ‘ওরে গলির কাছে একটা চায়ের দোকানে কামে লাগাইয়া দিছি। কাপ-টাপ ধুইব আরকি। সারা দিন টো-টো কইরা ঘুইরা বেড়ায়, কুনো কামকাজ করে না। এর থাইকা ওইখানে থাকলে ওর সময়ডা ভালো যাইব আর দুইডা পয়সাও পামু।’ আমি শুনে আকাশ থেকে পড়ি! বলি, ‘এত পিচ্চি ছেলে কীভাবে কাজ করবে? ওর তো এখন ছোটাছুটি করারই বয়স। এর থেকে আপনি ওকে স্কুলে দিতে পারতেন।’
খালা বলেন, ‘গরিবের পোলা, পড়ালেখা শিইখা কী করব? তা ছাড়া আমাগো কাছে তো আর জাদুর চেরাগ নাই যে যা চামু তাই পামু, আর পোলাডারে নতুন জামা-কাপড় পিইন্দা চক-সেলেট হাতে ধরাইয়া স্কুলে পাডামু।’
জাদুর চেরাগ! শব্দটা আমার কানে বাজে। আচ্ছা, আমার কাছে তো একটা জাদুর বাক্স আছে।এত দিনে নিশ্চয়ই অনেক কয়েন জমেছে। ওখান থেকে দিলেই তো মনে হয় টুকুর প্রাথমিক স্কুলের খরচটা মিটে যাবে।
বেশ উত্তেজনা কাজ করতে থাকে আমার ভেতর। খালাকে কিছু না বলে অপেক্ষা করতে থাকি কখন মা আসবেন তার জন্য। বিকেলে ফেরার সাথে সাথেই আমি টুকু আর জাদুর বাক্স নিয়ে মাকে বলি আমার ভাবনার কথা।
মা সাগ্রহেই তা মেনে নেন আর আশ্বাস দেন খালার সাথে কথা বলে সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেওয়ার।
বেশ কিছুদিন পর…
টুকুর সাথে আমার আড্ডা যথারীতি জমে উঠেছে আবার। মা বলেন, ‘ও এখন রোজ স্কুলে যায়—নতুন চকচকে স্কুলড্রেস পরে; হাতে চক, স্লেট আর হরেক রকমের রংবেরঙের বই নিয়ে।’ ইদানীং ওর পাকামো যেন আরও বেড়েছে। ও স্কুলে প্রতিদিন কী কী বাঁদরামি করে, তার ফিরিস্তি আমার কাছে দেওয়া চাই-ই চাই। আমি শুনি আর হাসি। আমার এত দিনের স্বার্থপর চাওয়াটা তো কোনো প্রকারে পূরণ হলো। নিজে আলোর দেখা নাই বা পেলাম, ওই পিচ্চিটাকে তো একটা আলোর সন্ধান দিতে পারলাম। আবছায়া আঁধারের মাঝে শিক্ষার এই আলোটুকুই হয়তো খুঁজে দেবে ওর ভবিষ্যতের পথের দিশা। এটাই কি কম প্রাপ্তি…!
শৈলকুপা পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ঝিনাইদহl