৭ মার্চ, ২০১৩, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের বক্তৃতার আদ্যোপান্ত নিয়ে চলচ্চিত্রনির্মাতা ফখরুল আরেফিন তৈরি করেছেন প্রামাণ্যচিত্র দ্য স্পিচ। কীভাবে, কেন নির্মিত হলো এ প্রামাণ্যচিত্র? এবারের সাতই মার্চে নির্মাতা জানাচ্ছেন সেসব…
‘একটি কবিতা লেখা হবে, তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/ লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে…।’ হ্যাঁ, সাতই মার্চ, ১৯৭১-এ সেদিনের রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সেই জনসমুদ্রে একটি কবিতা লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাই, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এটি সবার জানা ইতিহাস। সাতই মার্চের মহাকাব্যিক অভিব্যক্তির ফুটেজ আমরা সবাই দেখেছি। কিন্তু আমরা কি জানি, সেই প্রতিকূল সময়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার ফুটেজ কারা রক্ষা করেছিলেন? সাতই মার্চের ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তুতি কেমন ছিল—এমন টুকরো প্রশ্নের উত্তর আর সাতই মার্চের পূর্বাপর প্রেক্ষাপট নিয়ে দ্য স্পিচ শিরোনামে ২০১১ সালে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন ফখরুল আরেফিন। তার আগে আলবদর নামে আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন তিনি। এবার সেটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করেছে।
দ্য স্পিচ-এর নির্মাতা ফখরুল আরেফিনের সঙ্গে কথার শুরুতে এ হলো ভূমিকা।ভূমিকাটি শুনতে শুনতে আলাপ শুরু করলেন নির্মাতা, ‘মোরশেদুল ইসলামের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আগামীর একটি দৃশ্যে রাজাকারকে গুলতি মারে ছোট্ট ছেলে হাসু। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা যখন সদর্পে বলছিলেন, “যুদ্ধাপরাধ বলে কিছু নেই”, মনে হলো, কিছু একটা করা দরকার। তখনই ২০০৭ সালে তৈরি করলাম আলবদর—এটা অনেকটা রাজাকারদের “গুলতি” মারার মতো। আর দ্বিতীয় “গুলতি” দ্য স্পিচ। আলবদর বানানোর পরই সাতই মার্চের বক্তৃতার ফুটেজ সংরক্ষণ সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে পারলাম—শেখ মুজিবের সাতই মার্চের বক্তৃতার ফুটেজগুলো ডিএফপির লোকেরা প্রথমে একটি খড়ের গাদায় লুকিয়ে রাখে। পরে তারা এটি ঢাকার বাইরে পাচার করে দেয়। এসব জানার পর ভাবলাম, সাতই মার্চের ফুটেজ কীভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল, তা নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করব। কিন্তু পরে এ বিষয়ে পড়ালেখা করতে করতে শেখ মুজিবের বক্তৃতা আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করল।’
তিনি বলছেন। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা। ‘১ মার্চ সংসদ অধিবেশন মুলতবি করার পর একদিকে শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহের জালে জড়ানোর চেষ্টা হয়, অন্যদিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্য প্রস্তুতিও নেন তিনি এ সময়ে।তাই আমার মনে হয়, সাতই মার্চের স্বতঃস্ফূর্ত এই বক্তৃতার মধ্যেই শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা কোথা থেকে কীভাবে কে প্রচার করবেন, সে বন্দোবস্ত শেখ মুজিব আগেই করেছিলেন। প্রামাণ্যচিত্রে এই পুরো বিষয়ই ধরার চেষ্টা করেছি। ফলে অন্যান্য অনুষঙ্গের সঙ্গে বক্তৃতাকে মূল বিবেচনায় রেখে তৈরি হয়েছে দ্য স্পিচ।’
২০১০-এ শুরু হওয়া এ প্রামাণ্যচিত্রটির প্রথম প্রদর্শনী হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে ২০১১ সালের ১৫ মার্চ। প্রমাণ্যচিত্রে সাতই মার্চের ইতিহাস তুলে ধরতে অনেকের দরজায় ঢুঁ দিয়েছেন আরেফিন—ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, আ স ম আবদুর রব থেকে শুরু করে ফুটেজটি ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে নিয়ে গিয়েছিলেন যিনি, সেই আমজাদ খানের সাক্ষাৎকারও আছে এখানে। আছে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী হাজি গোলাম মোরশেদের কথা। ‘প্রামাণ্যচিত্রের সাক্ষাৎকারের জন্য আমি তাঁদেরই খুঁজে বের করেছি, যাঁদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে এখানে তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎকার নেই—এটা আমার প্রামাণ্যচিত্রের একটা বড় খামতি। তিনি না থাকার কারণে ইতিহাসের অনেক কিছুই অজানা থেকে গেল আমাদের।’ আরেফিনের কণ্ঠে ঝরে পড়ছে খেদ। ‘মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের সাক্ষাৎকার নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি কেন যে আমাকে সময় দেননি, তা আজও জানি না। তাঁর সাক্ষাৎকার পেলে এটি আরও ভালো হতো।’ বললেন তিনি।
কথায় কথায় নির্মাতার কাছ থেকে জানা গেল একটি করুণ ঘটনা—সাতই মার্চের বক্তৃতার যে অংশটুকু আমরা এখন শুনতে পাই, সেটির শব্দ সম্পাদনা করেছিলেন আবদুল মজিদ খান। প্রামাণ্যচিত্রের সাক্ষাৎকারের জন্য তিনি যেদিন তাঁর বাড়ি
গেলেন, শুনতে পেলেন, দু-এক দিন আগেই মারা গেছেন তিনি।
ঘটনাগুলো বলতে গিয়ে বারবার বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছেন নির্মাতা ফখরুল আরেফিন। তাঁর কথায় ফুটে উঠছে একের পর এক আক্ষেপ। তবে তিনি কি জানেন, দ্য স্পিচ ছবিটি এর মধ্যেই কতটা ‘গুলতি’ হয়ে উঠেছে ইতিহাসের আলোকমালা জ্বালিয়ে!