ডেস্ক রিপোর্ট:দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর সারা দেশে তাণ্ডব ও সহিংসতার ঘটনার জন্য জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি বিএনপিকেও দায়ী করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তবে নিরাপত্তা বাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ায় সারা দেশের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন।
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৩০০ বিধিতে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন। গত বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত পুলিশসহ ৬৭ জন নিহত হয়েছে বলে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বেআইনি কার্যকলাপ চালাতে উসকানিদাতা জামায়াত ও বিএনপির কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় নেতাদের এই মৃত্যুর দায় নিতে হবে।রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতির জন্য ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনের আওতায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের নাগরিকদের পরম সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও সাহসিকতা দেখিয়ে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় যেকোনো অনভিপ্রেত ঘটনা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কাজ করতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশে সব ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা, নৈরাজ্য ও দুষ্কৃতি দমনে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
গত বৃহস্পতিবার জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা শুরু হওয়ার ছয় দিনের মাথায় গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রথম সরকারের বক্তব্য পাওয়া গেল।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, সরকারের একার পক্ষে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৫০ মিনিটের দীর্ঘ বক্তব্যে নানা বিষয় থাকলেও বর্তমান অস্থিরতা নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য দল, সংগঠন ও নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনা বা ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের কোনো প্রস্তাব ছিল না। তবে তিনি দেশবাসীকে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গতকাল জাতীয় সংসদে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে মোকাবিলায় জাতীয় সংলাপ আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বিবৃতিতে বলেন, জামায়াত দলগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়েছে। এটা কেবল সরকারের নয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপতৎপরতা চালানোর শামিল। বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর এই হিংসাত্মক কাজে সংশ্লিষ্টতা ও সমর্থন দিয়ে নিজেদের ফ্যাসিবাদী চরিত্র ও ধর্মান্ধতাজনিত নেতিবাচক মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতির সফরের সময় হরতাল পালন ও সমর্থন করে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অকৃত্রিম বন্ধুত্বকে গোষ্ঠীগত স্বার্থরক্ষার কারণে আঘাত করেছে।
মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৪ মার্চ পর্যন্ত দেশে ২৩৫টি মামলা করা হয়েছে। এসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় এক হাজার ৫৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবাধিকার রক্ষার প্রধান দায়িত্বে পুলিশ। তার সঙ্গে বিজিবি, কোস্টগার্ড, আনসার-ভিডিপি ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় পুলিশ আইনগত ও পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। পুলিশ ও বিজিবি পেশাগত দায়িত্ব পালনে চরম সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য দেখিয়েছে এবং জনগণের জানমাল রক্ষায় জীবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সাঈদীর রায়ের পর বিকেলে জামায়াত-শিবির গাইবান্ধা জেলার বামনডাঙ্গা রেলস্টেশনে হামলা চালায়। তারা বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে চার পুলিশ কনস্টেবলকে কুপিয়ে, গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে।তিনজনকে গুরুতরভাবে জখম করে। এই তিনজনের এখনো জীবনাশঙ্কা আছে। বিকেলে আবারও তারা সুন্দরগঞ্জ থানায় আক্রমণ করে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে ছত্রভঙ্গ করার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় তিনজন হামলাকারী নিহত হয়। একই দিন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার রাজঘাটা থেকে ঠাকুরদীঘি পর্যন্ত জনগণের জানমাল রক্ষায় দায়িত্বরত পুলিশের ওপর হরতাল-সমর্থকেরা আক্রমণ চালায়। স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারা তিনজন পুলিশ সদস্যকে গুরুতরভাবে আহত করে এবং অস্ত্র কেড়ে নেয়। পরে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৭ জন সদস্য গুরুতর আহত হন। এঁদের মধ্যে ছয়জনকে আশঙ্কাজনকভাবে প্রথমে যশোর সিএমএইচ এবং পরে জরুরি ভিত্তিতে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। তাঁদের কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা নবনির্মিত পর্যটন মোটেলে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকলে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী প্রাণভয়ে ছাদের ওপর আশ্রয় নিলে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। তিনি বলেন, শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রধান কার্যালয়ে ব্যাপক লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা সমিতির আবাসিক এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে ৪৮টি পরিবারকে বাসায় আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ হামলায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বাঁশখালীতে দুলাল শীলের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে হরিদাস নামের একজন বাধা দিলে তাঁকে বেদম মারধর করে। পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান। এ ছাড়া বাবুল দাসের ডিজেলের দোকান, প্রদীপ দাসের মুদির দোকান, সন্দীপ দাসের আসবাবের দোকানে হামলা ও লুটপাট করা হয়। তারা হিন্দুদের ধর্মীয় উপাসনালয় ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনায় স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা অংশ নেন। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবির বগুড়ায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজউদ্দিনের বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। সাংসদ আবদুল মান্নানের বাড়িতেও হামলার চেষ্টা করে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়, আওয়ামী লীগের কার্যালয় এবং থানা ঘেরাও করে আক্রমণের চেষ্টা করে।পুলিশ আত্মরক্ষা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে কাঁদানে গ্যাসের শেল, শটগান, ও গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় চারজন মারা যায়। একই দিন মোকামতলা পুলিশ ফাঁড়িতেও হামলা করলে আত্মরক্ষায় পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, শটগান ও রাইফেলের গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় দুজন নিহত হয়।
মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানা সদরের প্রাচীরসংলগ্ন শহীদ মিনার ভাঙতে শুরু করলে পুলিশ বাধা দেয়। একপর্যায়ে তারা হিংস্ররূপ ধারণ করে থানার গেট ভেঙে আগুন লাগানোর চেষ্টা করে। সব রকম চেষ্টা করেও সশস্ত্র আক্রমণকারীদের নিবৃত্ত করা সম্ভব না হওয়ায় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোড়ে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় ছয়জন নিহত হয়।
বিএনপির প্রতিক্রিয়া: হামলায় স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা অংশ নেন বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপিকে দায়ী করছেন আর ওই দিকে বগুড়ার শেরপুরে শহীদ মিনারে ভাঙচুরের সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছেন যুবলীগের নেতা তৈয়বুর রহমান টিপু। তাঁকে জনতা পুলিশে সোপর্দ করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের থলের বিড়াল এখন বেরিয়ে আসছে। জনবিক্ষোভ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকারের লোকজন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালাচ্ছে বলে তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন।
এদিকে প্রথম আলোর শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, তৈয়বুর রহমান (টিপু) যুবলীগের শেরপুর শহর শাখার যুগ্ম সম্পাদক। উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক তারিকুল ইসলাম বলেন, টিপু মাদকাসক্ত এবং প্রায় ছয় মাস ধরে তাঁর আচরণ অস্বাভাবিক। এ কারণে তিনি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে জড়িত নন। গতকাল শহীদ মিনারের পতাকা উত্তোলনের দণ্ডের চারপাশে থাকা চারটি স্টিলের বলের একটি খুলে ফেলে।
শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম বলেন, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়ার পর টিপুকে গত রাতে তাঁর পরিবারের কাছে তুলে দেওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি জামায়াতের: জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, স্বতঃস্ফূর্ত জনতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ঘোষিত রায় প্রত্যাখ্যান করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু তাদের প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নিয়ে সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী ‘গণহত্যায়’ মেতে ওঠে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য গত আট দিনে নিহত ‘১৪৭ জন’ সাধারণ মানুষের প্রতি চরম উপহাস ছাড়া আর কিছু নয়।
৬ মার্চ/নিউজরুম