৬ মার্চ, ২০১৩,শিল্পকে পাঠ করার অভিজ্ঞতায় সময় তৈরি করে গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য। জল মাটি আলো হাওয়া আর মানুষ—রং-রেখায় বিবৃত হয় চিত্রপটে। শিল্পীর চিত্রতল ধ্যানস্থ হয় রূপকল্পের প্রেরণা আর নিজস্ব মনোভঙ্গিতে। প্রকৃতি আর মানুষ যেসব গুণী শিল্পীর ক্যানভাসে প্রধান হয়ে উঠেছে, তাঁদের মধ্যে মনসুর-উল-করিম অন্যতম।এই শিল্পীর চিত্রভাষায় একাকার হয়ে এসেছে প্রকৃতি আর মানবিক অবয়বের বিমূর্ত পিপাসা; উজ্জ্বল রং-রেখার জলতরঙ্গ, রঙিন জীবন, খেয়ালি নিসর্গ, অবিভাজিত মানবতাবোধ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আর ভাবনাকে প্রসারিত করেছে ক্রমাগত।
চট্টগ্রামের পাহাড়ি সবুজ পরিবেশে শিল্পী মনসুর-উল-করিম তাঁর শিল্পচর্চার গভীরতাকে শাণিত করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। মানবতা আর প্রকৃতি-লগ্নতাকে একই সুতোয় বেঁধে এগিয়ে চলেছেন নিসর্গের পথ বেয়ে। ভিরিডিয়ান গ্রিন, কোবাল্ট ব্লু আর বার্ন্ট সিয়েনার অনুভবে চিত্রতল ভরে উঠেছে রৈখিক কারুকার্যে। শিল্পী মনসুর নিজেকে ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক ভাবতে পছন্দ করেন। ‘প্রতিটি মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। যে নিজেকে ভালোবাসে, সে তার পরিবেশ, চারপাশের মানুষ, মাটি, দেশকে ভালোবাসে। আমিও তেমনি, নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।আমার পরিবেশ-চিন্তা তাই ফুটে ওঠে আমার ছবিতে।’ বর্ণিল পটভূমিতে সতেজ পাণ্ডুলিপি স্মৃতিবিজড়িত হয়ে ওঠে শিল্পীর ভাবনায়। ‘আমার শৈশব-কৈশোরের গ্রামীণ পরিবেশ যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি তা ভীষণভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাকে। পদ্মা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে আমি জন্মেছি।’
শিল্পী মনসুর আবিষ্ট হয়ে রয়েছেন পদ্মা নদীর সংস্পর্শে থাকা সরল-সাধারণ মানুষের জীবনধারণের প্রক্রিয়ায়। এই নস্টালজিয়া তাঁর ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে ফিরে ফিরে এসেছে। তিনি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছেন অতীতের রসদে ভাঁড়ার পূর্ণ করে; নিসর্গের প্রতি শিল্পীর আকুলতা আর বাস্তবতার নিরিখে চিত্রপটের উপস্থাপন আমাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে।
শিল্পী মনসুর অকপটে স্বীকার করেন, ‘আমি ইউরোপিয়ান শিল্পীদের দিয়ে সরাসরি প্রভাবিত হয়েছিলাম। তাদের অনুসরণ-অনুকরণ করেছি।’ শিল্পশিক্ষায় মূলত সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। পরবর্তী সময়ে অনেক নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ-মনোবিশ্লেষণে নিজস্ব পরিবেশ থেকে নতুন অভিযাত্রা সংহত হয়েছে শিল্পী মনসুরের।
সত্তরের দশকে তাঁর ছবিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল চট্টগ্রামের পরিবেশ।পাহাড়-সমুদ্র আর পাহাড়ি জনজীবন ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে তখন।‘এসময়ে আমার ছবির রং-রেখা-টেক্সচারে ভিন্নতা এসেছিল—স্নায়বিক এবং দৃষ্টির স্বস্তি প্রদান করে, এ ধরনের রঙের প্রাধান্য ছিল।’ তিনি অর্গানিক ফর্ম এবং জিওমেট্রিক ফর্মের ওপর গুরুত্ব বেশি দিয়েছিলেন সে সময়। প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত অর্গানিক ফর্ম বরাবরই ভীষণভাবে তাড়িত আর আকৃষ্ট করেছে এই শিল্পীকে।
শিল্পী মনসুর-উল-করিম সিরিজভিত্তিক ছবি আঁকতে পছন্দ করেন।সর্বশেষ তিনি ‘পদ্মা পুরাণ’ সিরিজ করেছেন, যা পরিপার্শ্বের অভিজ্ঞতায় ভিন্ন উচ্চারণ। পদ্মা নদীর অববাহিকার মানুষের জীবনের জয়গান, তাদের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-হাসি-গান—সবকিছুই অভিব্যক্ত করেছেন এই ‘পদ্মা পুরাণ’-এ।পদ্মা-পারের জীবনের একটি বিশেষ দিক—পদ্মার হিংস্র রূপ। যে মানুষগুলো এই নদীর ভাঙনে নিজেদের বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, এরপর তাদের ঠিকানা কোথায়? এই বোধে শিল্পী মনসুর বিশেষভাবে তাড়িত হয়েছেন। এরই অভিব্যক্তি ‘পথের মানুষ’ শিরোনামে তাঁর নতুন সিরিজের শিল্পকর্ম। শিল্পী মনসুর ভাবছেন, এই ভাঙনের ঘটনায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া মানুষগুলো পরে শহরে এসে যেভাবে জীবনধারণ করছে, তা কি কোনোভাবে প্রচলিত নিয়মের বাইরে নতুন জনমিতি বা অস্তিত্বের ফাটলকে উপস্থাপন করে?
আমাদের দেশের শিল্পকলার সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ে শিল্পশিক্ষার পরিবেশ ভিন্নতর ছিল, জানার পরিধিও ছিল কম। এখনকার ছেলেমেয়েরা গ্লোবাল পৃথিবীর সুবিধা পাচ্ছে। তবে আমাদের শিল্পের অবস্থান সত্যিকার অর্থে কোথায়, সে সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে হবে। নিজস্ব আইডেন্টিটিই শেষ পর্যন্ত শিল্প ও শিল্পীকে কালোত্তীর্ণতার মহিমায় ভূষিত করে।’
শিল্পী মনসুর-উল-করিম: ১৯৫০ সালে রাজবাড়ী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বিএফএ এবং ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএফএ করেছেন। ২০০৯ সালে তিনি পেয়েছেন ‘একুশে পদক’। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে অধ্যাপনা করছেন।