কৃষি ডেস্ক: সন্ধ্যার পর ১৫টি ইউনিয়নে নেমে আসে ভুতুড়ে পরিবেশ। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা লেখাপড়া করতে পারে না। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বোরোচাষিরা। গভীর নলকূপগুলো বন্ধ। ধানখেতে পানি নেই। কোনো কোনো খেতের মাটি পেটে গেছে। আর দু-তিন দিন এভাবে চললে অধিকাংশ বোরো ধানখেত ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে পিঁয়াজ-রসুনের খেতও।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় গত তিন দিন ধরে বিদ্যুতের অভাবে চলছে এই বিভীষিকাময় অবস্থা। গত বৃহস্পতিবার জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা শিবগঞ্জের কানসাটে অবস্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সদর দপ্তর আগুনে পুড়িয়ে দেয়।বিদ্যুতের একটি উপকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয় তারা। এতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি।
বৃহস্পতিবার শিবগঞ্জের ধোপপুকুর এলাকার একটি পেট্রলপাম্পে গিয়ে দেখা যায়, ডিজেল কেনার জন্য লম্বা লাইন দিয়েছেন বোরোচাষিরা। তাঁরা জানান, ৬০ টাকা লিটারের ডিজেল কিনতে হচ্ছে ৭০ টাকা করে। এক বিঘা জমিতে সেচের জন্য কমপক্ষে ৪০ লিটার ডিজেল দরকার হয়।সেখানে খরকপুর গ্রামের নুরুল ইসলাম (৬০) বলেন, ‘তিন দিন ধরে জমিতে পানি নেই। তাই শ্যালো মেশিন জোগাড় করে ডিজেল কিনতে এসেছি।’ মনাকষা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) শাহাপাড়া গ্রামের আনারুল ইসলাম বলেন, ‘সাত বিঘা জমিতে আবাদ করেছি ধার-দেনা করে। বিদ্যুৎ না এলে এবার বউয়ের গয়না ও গরু-ছাগল বিক্রি করে দেনা শোধ করতে হবে।’ শাহবাজপুর ইউপির পারদিলালপুর গ্রামের কৃষক আজাহার আলী (৭৫) জানান, বিদ্যুৎ না থাকায় এলাকায় হাজার হাজার কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে।তাঁর নিজের তিন বিঘা জমি পানির অভাবে ফেটে গেছে।
সূত্র জানায়, উপজেলায় সাড়ে নয় হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৬৭০ হেক্টর জমির সেচ পল্লী বিদ্যুতের আওতায়।
কানসাট ইউনিয়নের পুঠিমারী বিলে হাজার বিঘা জমিতে আবাদ হয়েছে। পশ্চিম বিলাত হরিরামপুর মৌজার গভীর নলকূপের আওতায় আবাদ হয়েছে ১৭৫ বিঘা। এর মধ্যে বেশ কিছু বোরো খেতের মাটি ফাটা শুরু হয়েছে। জমির পাশে হতাশ হয়ে বসেছিলেন হরিপুর গ্রামের কৃষক ওমর আলী। তিনি বলেন, ‘হামার তিন বিঘা আবাদ। সবই ফাটতে ল্যাগাছে। হামার বুঝিন সবই শ্যাষ হয়্যা যাইবে।’
বিদ্যুতের অভাবে মোবাইল ফোনে চার্জ করা সম্ভব হচ্ছে না।ধোপপুকুরে একটি পেট্রলপাম্পে দেখা যায় টাকার বিনিময়ে মোবাইল ফোন চার্জ করা হচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এখানে এসে মোবাইল ফোনে চার্জ করছেন। সেখানে পশ্চিম বিলাত হরিরামপুর কৃষক সমবায় সমিতির সভাপতি বেলাল উদ্দীন বলেন, ‘কৃষকের হাহাকার দেখে আমরা দল বেঁধে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অফিসে গিয়েছিলাম।কিন্তু কখন আবার বিদ্যুৎ আসবে তার নিশ্চয়তা তারাও দিতে পারছে না।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কনিষ্ঠ প্রকৌশলী কফিল উদ্দীন বলেন, ‘১৫ মেগাওয়াটের একটি সাবস্টেশন। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবস্থা দেখে গেছেন। মেরমতের জন্য যন্ত্রপাতি এলে কাজ শুরু হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন তিন দিনের হরতালের কারণে যন্ত্রপাতি আসতে দেরি হতে পারে।’ তিনি জানান, বাণিজ্যিক, কৃষি ও আবাসিক মিলিয়ে ৫৮ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বোরোচাষিরা।
কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলনের নেতা গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যুতের জন্য এত বড় আন্দোলন হয়েছে, ১৭ জন মানুষ জীবন দিয়েছে। কিন্তু তখন ওই উত্তপ্ত অবস্থার মধ্যেও কেউ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এত বড় ক্ষতি করেনি। ’৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত যেমন ইসলামের নামে মানুষের ওপর নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, সেই ধারাবাহিকতা তারা বজায় রেখেছে। ’৭১-এর কায়দায় তারা এই বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে। সমিতির আবাসিক ভবনে থাকা মা-বোনদের লাঞ্ছিত করেছে। পরিবারগুলোকে এক কাপড়ে তাড়িয়ে দিয়ে বাড়িগুলোতে আগুন দিয়েছে। লুটপাট করেছে।’ তিনি বলেন, ‘এই নারকীয় ঘটনায় জড়িত জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের আমরা ধিক্কার জানাচ্ছি। তাদের কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
বিদ্যুৎ না থাকায় কেরোসিন ও মোমবাতির দাম বেড়েছে। পুকুরিয়া গ্রামের গৃহবধূ পারুল বেগম বলেন, ‘পাঁচ টাকার মোমবাতি কিনতে হচ্ছে আট টাকা দিয়ে। ৮০ টাকার কেরোসিন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা কেজি দরে। না কিনেও উপায় নেই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছে।’ এই গৃহবধূ আরও জানান, ফ্রিজে রাখা মাছ-মাংস নষ্ট হয়ে গেছে।
কানসাট আব্বাস বাজারের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম ও আনসারুল হক জানান, কেরোসিন-মোমবাতি জন্য মানুষ ছোটাছুটি করছে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে।
৩ মার্চ/নিউজরুম