তামাক চাষ বাড়ছে

0
248
Print Friendly, PDF & Email

কৃষি ডেস্ক: তামাকের চাষ বাড়ছেফসলি জমি, মাতামুহুরী নদীর দুপাড় ও চর, বমু সংরক্ষিত বনাঞ্চল, উপজেলা ও থানা প্রশাসনের জমি এবং গহীন অরণ্যে তামাক চাষ করা হচ্ছেতামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে তামাক কোম্পানি এবং কৃষি বিভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় চলতি মৌসুমে তামাক চাষ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছেএকই জমিতে বার বার তামাক চাষের ফলে পরিবেশ, পাহাড়-মাটি, নদী-খাল ও প্রাণীবৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, লামায় ১০ হাজার ১১৬ হেক্টর আবাদী জমি রয়েছেতন্মধ্যে চলতি মৌসুমে ২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ও ১ হাজার ৩৩২ হেক্টর জমিতে সবজি ও মসলা জাতীয় চাষ হয়েছেএই হিসেবে তামাক চাষ হয়েছে ৬ হাজার ২৩৪ হেক্টর ফসলি জমিতেকিন্তু কৃষি বিভাগ বলছে, উপজেলায় তামাক চাষ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ১৪৯ হেক্টর জমিতেবাস্তবে মাতামুহুরী নদীর চর, পাড়সহ এর পরিমাণ ৮ হাজার হেক্টরের বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৮৩-৮৪ সালে রাঙ্গুনিয়া টোব্যাকো কোম্পানি লামা পৌর এলাকার লামামুখ গ্রামে সর্বপ্রথম তামাক চাষ শুরু করেপরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যকো বাংলাদেশ, ঢাকা, আবুল খায়ের, নাসির, কেবি ও নিউএজ টোব্যাকো কোম্পানি পর্যায়ক্রমে উপজেলার রুপসীপাড়া, গজালিয়া, লামা সদর, ফাঁসিয়াখালী, আজিজনগর, ফাইতং ও সরই ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকার উর্বর জমিগুলোতে তামাক চাষ শুরু করেএক সময়ে এখানকার উত্পাদিত রকমারি রবিশস্য স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রফতানি হতোগত দেড় দশকের ব্যবধানে এখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ কৃষি জমি দখল করে নিয়েছে তামাক চাষ
সরেজমিন লামা বনবিভাগের বমু সংরক্ষিত বনাঞ্চল, উপজেলা ও থানা প্রশাসনের জমি, পৌর এলাকার লাইনঝিরি, কলিঙ্গাবিল, রুপসীপাড়া ইউনিয়নের শীলেরতুয়া এলাকাসহ মাতামুহুরী নদীসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, এসব জমিতে ব্যাপকহারে তামাকের আবাদ হয়েছেকোনো ধরনের সবজি কিংবা বোরো আবাদ চোখে পড়েনি তিল পরিমাণযেদিকেই চোখ যায় শুধু তামাক আর তামাকের আবাদ চোখে পড়েশীলেরতুয়া এলাকার সবজি চাষী হায়দার আলী ও রেপারপাড়ার কৃষক মনোহর আলী বলেন, চলতি মৌসুমে তামাকের পরিবর্তে সবজি চাষ করে দ্বিগুণ লাভ করেছিআশা করি কৃষকরা আমাদের দেখাদেখি সবজি চাষে আগ্রহী হবেন
বান্দরবানের পরিবেশবাদী ও সাংবাদিক আলাউদ্দিন শাহরিয়ার জানান, বার বার একই জমিতে তামাক চাষের ফলে যেমন এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মাটির উর্বরতা ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি রবিশস্যের উত্পাদনে নেপথ্যচারী হিসেবে নানা অন্তরায় সৃষ্টি করে যাচ্ছেতাই জনস্বার্থে ২০১০ সালে তামাক চাষ বন্ধে মামলা করা হয়েছেকিন্তু কোম্পানিগুলো আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এখনও তামাক চাষ অব্যাহত রেখেছেএ বিষয়ে টোব্যাকো কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি
জানা গেছে, ২০১১ সালে মৃত্তিকা বৈজ্ঞানিকরা উপজেলার ৪৫ জন কৃষকের জমির মাটি পরীক্ষা করেনতাদের পরীক্ষায় জমিগুলোর মাটির উপাদান সর্বনিম্নে বলে পরিলক্ষিত হয়তামাক ক্ষেতে মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগের পাশাপাশি কৃষকরা অতিরিক্ত ম্যাগনেশিয়াম, জিংক এবং সালফার প্রয়োগ করে থাকেনফলে ফসলি জমির মাটির মুখ্য এবং গৌন মোট ১৬টি উপাদান দ্রুত নষ্ট হয়ে প্রকৃত গুণাগুণ হারাচ্ছে
লামা উপজেলা মত্স্য কর্মকর্তা ছাবেদুল হক জানিয়েছেন, তামাক চাষে ব্যবহৃত অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ফলে শুধু মাটি ও মানুষের ক্ষতি হচ্ছে না, পাশাপাশি পশু-পাখিসহ স্থানীয় নদী, ঝিরি ও খালের মাছের বংশ বিস্তার ধ্বংস হচ্ছেলামা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শফিউর রহমান মজুমদার জানিয়েছেন, তামাক শোধনের সময় নির্গত নিকোটিনের কারণে এলাকার লোকজন হাঁপানি, কাশি এবং ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে
লামা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. আইয়ুব আলী জানিয়েছেন, তামাক চাষ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক, এতে কোনো সন্দেহ নেইকিন্তু এখানে নিয়োজিত ট্যোবাকো কোম্পানিগুলোর ফাঁদে আটকে পড়ে কৃষকরা এ চাষ করতে বাধ্য হচ্ছেতাই এখনই তামাক চাষ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজনঅন্যথায় প্রতি বছর আবাদি জমি হ্রাস পেয়ে অচিরেই উপজেলার খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে
তামাকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের কক্সবাজারের আঞ্চলিক সমন্বয়ক রফিকুল হক টিটো সাংবাদিকদের বলেছেন, তামাক চাষের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখনী হচ্ছে প্রতিনিয়তসবচেয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছে খাদ্য ফসলের আবাদি জমিকারণ তামাক চাষে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির অণুজীব নষ্ট হচ্ছে এবং জমি হারাচ্ছে উর্বরতা শক্তিফলে ওই জমিতে শত চেষ্টা করলেও অন্য কোনো ফসল উত্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে নাতিনি আরও বলেন, উবিনীগ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে তামাকের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে
তামাক চাষের আগ্রাসনের কথা স্বীকার করে লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. এনামুল হক জানান, কৃষকদের তামাক চাষে নিরুত্সাহিত করার পাশাপাশি বিকল্প আখ, গম, সবজি, ভুট্টাসহ বিভিন্ন চাষের প্রতি উত্সাহিত করেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে নাতামাক কোম্পানিগুলোর মতো সরকারিভাবে যদি একই পদ্ধতি অনুসরণ করে কৃষকদের সহযোগিতা করা যেত; তাহলে কৃষককে তামাক চাষ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভবলামা উপজেলা প্রশাসনের জমিতে তামাক আবাদের সত্যতা স্বীকার করে নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, আমার আগের নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা প্রশাসনের জমি লিজ দিয়েছেনভবিষ্যতে তামাক না করার শর্তে প্রশাসনের জমি লিজ দেয়া হবে

 

২ মার্চ/নিউজরুম

 

শেয়ার করুন