ব্যবসা ও অর্থনীতি: নান্দনিকগৃহসজ্জায় শৌখিন ব্যক্তিদের পছন্দের তালিকায় আছে বেতের আসবাব। একসময় এসবপণ্যের কাঁচামাল বেত দেশেই চাষ হতো, আর এখন সিংহভাগই বিদেশ থেকে আনতে হয়।এই পরনির্ভরশীলতার কারণে বেতের সামগ্রীর উৎপাদন ব্যয় যেমন বেড়েছে, তেমনিদাম বেড়ে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এ কারণে বাজার সংকুচিতহয়ে এখন অস্তিত্বসংকটে পড়েছে দেশীয় বেতশিল্প। দেশে উৎপাদন কমে যাওয়া ছাড়াওসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে নাপারা ও কাঁচামাল আমদানিতে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণকেই বেতশিল্পেরদুর্দিনের কারণ হিসেবে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
একাধিক ব্যবসায়ী জানান, দেশে বহু আগ থেকেই পরিমাণে কম হলেও বেতের আসবাব ব্যবহূত হয়ে আসছে। নব্বইয়েরদশকের শুরুর দিকে রুচিশীল মানুষ এসব আসবাবের দিকে নতুন করে ঝুঁকতে থাকে।তখন স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বেতেরকিছু সামগ্রী রপ্তানিও হতো।
বেতের খাট, সোফা সেট, ডাইনিং টেবিল, ড্রেসিংটেবিল, চেয়ার, আলমারি, মোড়া, তেপায়া ইত্যাদি আসবাব ক্রেতাদের চাহিদাঅনুযায়ী তৈরি করে দেন ব্যবসায়ীরা। আর তৈরি অবস্থায় বিক্রির ব্যবস্থা তোআছেই। এ ছাড়া বেত দিয়ে তৈরি শীতলপাটি অনেকের কাছেই বেশ জনপ্রিয়।
এসবপণ্য তৈরির কাঁচামাল গল্লা, ভূতুম, কেরেক, গুটা, ফালি ও গুলবুকা প্রজাতিরবেত সিলেট, বান্দরবানসহ দেশের পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হতো।তবে সেই দিন আর নেই। ১০ বছর ধরে অল্প কিছু ফালি ও গুটা বেত ছাড়া বাকিগুলোদেশের কোথাও আর চাষ হচ্ছে না।
চাহিদা বৃদ্ধি আর উৎপাদন হ্রাসের কারণে২০০০ সালের পর থেকে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়েই বেত আমদানি শুরু করেন। এত দিনইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে বেত আনা হতো।
তবে গতবছরের জুন মাস থেকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সরকার নিজ দেশের চাহিদা মেটাতেবেত রপ্তানি নিষিদ্ধ করে দেয়। এ কারণে এক বছরের ব্যবধানে আমদানীকৃত বেতেরদাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। গতবার যে বেতের কেজি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ছিল, এবার তা এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তা ছাড়া মাত্রদু-তিনজন ব্যবসায়ী বেত আমদানি করেছেন। তাঁরা ইচ্ছেমাফিক দাম বাড়ান। এ কারণেক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়ছেন বলে জানান পান্থপথেরব্যবসায়ীরা।
ঢাকার পান্থপথ, রামপুরা, বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ী, গুলশান রিংরোড, গুলিস্তান ও মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় বেতের আসবাবের অন্তত ২৫টি দোকানআছে। এর বেশির ভাগই পান্থপথে। এ ছাড়া দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেবেশ কিছু দোকান।
বর্তমানে পাঁচ আসনের সোফা সেট সাড়ে ১৩ হাজার থেকে একলাখ টাকা, চার আসনের ডাইনিং টেবিলের সেট ১৪ হাজার থেকে ৩০ হাজার, খাট সাড়েছয় হাজার থেকে ২৫ হাজার, চেয়ার দুই হাজার থেকে ১০ হাজার, আলমারি ১০ হাজারথেকে ৩৫ হাজার, ওয়ার্ডরোব সাড়ে তিন হাজার থেকে ১৬ হাজার ও ড্রেসিং টেবিলসাড়ে চার হাজার থেকে ১২ হাজার টাকায় পাওয়া যায়।
শাহজালাল কেইন ফার্নিচারগ্যালারির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, বেতের আসবাব ১৫ থেকে২০ বছর অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া রুচিশীল ও ভিন্নধর্মী সাজ্জসজ্জারজন্য অনেকে এই পণ্যের প্রতি আগ্রহ দেখান। তিনি আরও বলেন, বেত আমদানিতে খরচঅনেক। ক্রেতা ধরে রাখার জন্য মুনাফা কমিয়ে দিয়েও লাভ হচ্ছে না। আগে মাসেছয়-থেকে লাখ টাকার বেচাবিক্রি হতো। এখন অর্ধেকও হচ্ছে না। তাই অনেকেই বেতেরব্যবসায় ছেড়ে দিচ্ছেন।
সিলেটে ধূসর অতীত: একসময় সিলেটের বালাগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও সদর উপজেলায় প্রচুর পরিমাণ বেত চাষ হতো। সেই বেতই সারা দেশেরচাহিদা পূরণ করত। এখন সালুটিকর এলাকা ছাড়া আর কোথাও তেমন বেত চাষ হয় না।
নগরেরলালদীঘিরপাড় এলাকায় গত সোমবার বেতের সামগ্রী কিনতে এসেছেন সেনপাড়া এলাকারবাসিন্দা পিনাক ভৌমিক। তিনি বলেন, আগে বেতের সামগ্রী হাটবাজারে প্রচুরপাওয়া যেত। এখন সোফা, টেবিল ও শীতলপাটি ছাড়া বেতের সামগ্রী চোখেই পড়ে না।
কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ক্ষুদ্র ওকুটির শিল্পের উদ্যোক্তারা উদ্যোগ নিলে এখনো বেতের সুদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব।তিনি আরও বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন: প্লাস্টিক, কাঠ, মেলামাইনসামগ্রীবাজার দখল করে নেওয়ায় বেতশিল্প প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। এ ছাড়াউৎপাদন খরচের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওসব পণ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা সম্ভবহচ্ছে না। এ কারণে বেতশিল্প ক্রমেই ঐতিহ্য হারিয়ে স্লান হয়ে পড়ছে।
সম্ভাবনারদুয়ার: বেতের সঙ্গে বাঁশের আসবাবও এখন তৈরি হচ্ছে। নকশা ও মানে অনেকক্ষেত্রেই তা বিদেশি পণ্যের চেয়ে স্বতন্ত্র। ফলে দেশি অন্যান্য পণ্যেরসঙ্গে বেতের আসবাবপত্র রপ্তানি খাতে যুক্ত করা সম্ভব বলে মনে করেনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জাকির হোসেন বলেন, ‘দেশে-বিদেশে বেতের আসবাবেরব্যাপক চাহিদা আছে। এ সুযোগ আমাদের কাছে লাগাতে হবে। সরকারকে বেত চাষেরবিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে অথবা সহজে বেতপ্রাপ্তির বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।তাহলেই পিছিয়ে পড়া এই খাত দিয়ে বিপ্লব ঘটানো যাবে। অন্যথায় বেতশিল্প ধ্বংসহতে বেশি সময় লাগবে না।’
২ মার্চ/নিউজরুম