আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: জালিয়ানওয়ালাবাগগিয়েও জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের জন্য ক্ষমা না চেয়েবিতর্ক উসকে দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। প্রথমআলোর কলকাতা প্রতিনিধি লিখেছেন জায়গাটি ঘুরে এসে।
ভারতের পাঞ্জাবরাজ্যের শিখ ধর্মাবলম্বীদের পুণ্য শহর অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ। এরপাশেই শিখ তীর্থভূমি স্বর্ণমন্দির। গত শতকের গোড়ার দিকে এইজালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশরা চালায় ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনকহত্যাকাণ্ড যা ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত। এ ঘটনার দীর্ঘ৯৪ বছর পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডস্থলে এসে এই প্রথম ক্ষমতায় থাকাএকজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সেই প্রধানমন্ত্রীর নামডেভিড ক্যামেরন।
কেন এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড আর কেনই বা এই দুঃখ প্রকাশ? ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল, রোববার। দিনটি ছিল শিখদের নববর্ষ উৎসব।স্বর্ণমন্দিরসংলগ্ন জালিয়ানওয়ালাবাগে বিশেষ প্রার্থনাসভায় উপস্থিতহয়েছিলেন অমৃতসরের নানা ধর্মের অন্তত ২০ হাজার মানুষ। শহরে তখন চলছেসামরিক আইন রাওলাট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলন থামাতে ব্রিটিশসরকার জারি করেছে ১৪৪ ধারা। সে ধারা ভঙ্গ করেই নববর্ষ উৎসব পালনের জন্যসবাই সমবেত হয়েছে জালিয়ানওয়ালাবাগের ঐতিহাসিক ময়দানে। ময়দানের চারপাশদেয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রবেশদ্বারও ছোট। ব্রিটিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেলডায়ারের কানে পৌঁছে যায় এই জমায়েতের কথা। তৎক্ষণাৎ ডায়ার ৫০ জনরাইফেলধারী সেনা নিয়ে হাজির জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই প্রার্থনাসভায়। মূলফটক বন্ধ করে নিরীহ ও নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। এইময়দানের পাশেই ছিল একটি কুয়ো। গুলিবর্ষণের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায়উপস্থিত লোকজন। গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ে একে একে। চলে ছোটাছুটি। পাশেরকুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে প্রায় ৩০০ নারী-পুরুষ-শিশু।একটানা ১০ মিনিট ধরে চলে গুলিবর্ষণ। এক হাজার ৬৫০টি গুলি কেড়ে নেয় প্রায়দেড় হাজার মানুষের প্রাণ।
এ ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়লে গোটা দেশেররাজনীতি হয়ে পড়ে উত্তাল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।খেপে ওঠেন মহাত্মা গান্ধী। ডাক দেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।প্রত্যাখ্যান করেন ব্রিটিশদের দেওয়া নাইটহুড সম্মান। দেশজুড়েব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ায় গণমানুষের চাপে ব্রিটিশসরকার গঠন করে একটি তদন্ত কমিটি। তদন্ত শেষে ঘোষণা দেওয়া হয় এই নারকীয়হত্যাযজ্ঞে নিহত মাত্র ৩৭৯ আর আহত এক হাজার ১০০ জন। যদিও সেদিন জাতীয়কংগ্রেস দাবি করে এই হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছে সহস্রাধিক মানুষ। তৎকালীনসিভিল সার্জন ডা. স্মিথ জানান, এই হত্যাযজ্ঞে নিহত মানুষের সংখ্যা এক হাজার৫২৬ জন।
ঘটনার পরপরই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারকে অপসারণ করে ব্রিটিশসরকার। তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় লন্ডন। কিন্তু প্রতিশোধের আগুন ধিকি ধিকিজ্বলতে থাকে শিখদের মধ্যে। সে আগুনের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এক শিখ যুবকলন্ডনে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে ডায়ারকে। ডায়ার তখন লন্ডনের ক্যাক্সটনহলে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতস্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫১ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্যআইন করে গড়া হয় স্মৃতিসৌধ ও স্মারক। আমি এবং আলোকচিত্রী ভাস্কর মুখার্জিকলকাতা থেকে যখন প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগেপৌঁছালাম তখন সকাল ১০টা। শত শত মানুষ প্রবেশ করেছে এই ঐতিহাসিক ময়দানেসেদিনকার সেই হত্যাযজ্ঞকে স্মরণ করতে। প্রবেশদ্বারটি এখনো সেই ছোট্টটিইরয়ে গেছে। সেখান দিয়ে প্রবেশ করেই আমরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লালবেলে পাথরের শহীদ স্মৃতিসৌধের কাছে এগিয়ে গেলাম। সামনে ফুলের বাগান।সুন্দরভাবে সংরক্ষিত। এর কাছেই সেই ঐতিহাসিক কুয়ো। এটিও সংরক্ষিত। লোহারজাল দিয়ে ঘেরা কুয়োটির ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা না থাকলেও বাইরে থেকে বেশদেখা যায়। কুয়োর ওপর তৈরি করা হয়েছে একটি স্মারক ভবন।জালিয়ানওয়ালাবাগের এই ঐতিহাসিক বাগানে আরও তৈরি করা হয়েছে শহীদদেরস্মরণে ‘অমর জ্যোতি’ নামে শিখা অনির্বাণ। ২৪ ঘণ্টাই জ্বলছে এই শিখা। আর সেইঐতিহাসিক প্রবেশপথের সামনে, যেখানে দাঁড়িয়ে ব্রিগেডিয়ার ডায়ারেরনির্দেশে গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল সেখানেও নির্মাণ করা হয়েছে একটি স্মারকস্তম্ভ। সেই স্মারক স্তম্ভের চারদিকে লেখা রয়েছে, এখান থেকেই গুলিবর্ষণকরা হয়েছিল নিরস্ত্র জনতার ওপর। প্রবেশদ্বারের আরেক পাশে রয়েছেজালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাযজ্ঞের ঐতিহাসিক স্মারক। এখানে গড়া হয়েছে সেইহত্যাযজ্ঞকে নিয়ে একটি সংগ্রহশালা। সেখানে রাখা হয়েছে সেই হত্যাকাণ্ডেরনানা স্মারক ও ঐতিহাসিক দলিল। আর এই জাদুঘরের দোতলায় নিয়মিত প্রদর্শিতহয় জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র।
এবার ২০ফেব্রুয়ারি জালিয়ানওয়ালাবাগের এই হত্যাযজ্ঞস্থলে এসে দুঃখ প্রকাশ করলেনব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন। তিন দিনের ভারত সফরে এসে তিনি ছুটেগিয়েছিলেন পাঞ্জাবের এই ঐতিহাসিক জালিয়ানওয়ালাবাগে। শহীদ স্মৃতিসৌধেরসামনে হাঁটু গেড়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। পরিদর্শন বইয়েলিখেছেন, ‘ব্রিটিশদের ইতিহাসে এটা ছিল চরম লজ্জাজনক একটি ঘটনা। এখানে যাঘটেছিল তা কোনোভাবেই ভোলার নয়।’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরজালিয়ানওয়ালাবাগ পরিদর্শনের খবর প্রচারিত হওয়ার পর শহীদ পরিবারেরসংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছিল এই ঘটনার জন্য ব্রিটিশপ্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু সেদিনের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশকরলেও ক্ষমা চাননি ক্যামেরন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চাওয়ারবিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেছেন, ‘এটি লজ্জাজনক ঘটনা।’ এর আগে ১৯২০ সালে এইঘটনাকে ‘নিষ্ঠুর’ বলে মন্তব্য করেছিলেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীউইনস্টন চার্চিল। আর ১৯৯৭ সালে ভারত সফরকালে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয়এলিজাবেথ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক দিয়ে বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের দুঃখজনকমুহূর্তগুলোর বেদনাদায়ক উদাহরণ এটি।’ –
১ মার্চ/নিউজরুম