নিউ গীতশ্রী সুরভান্ডার

0
236
Print Friendly, PDF & Email

তুমি কোলে তুলে নিয়েছিলে সেতার, মিড় দিলে নিষ্ঠুর করে
ছিন্ন যবে হলো তার ফেলে গেলে ভূমি-পরে
কলকাতাথেকে নতুন পাঁচটা সেতার আনালেন এবার রজত গিরি গুপ্ততাঁর ছোটখাটোদোকানটির বাঁ দিকের কাচের শেলফে পাঁচটি সেতারই পাশাপাশি সাজানোএখনো একটিওবিক্রি হয়নিঅথচ তিন সপ্তাহ আগেই ঢাকার দুজন আর চট্টগ্রামের একজনসেতারের জন্য তাঁকে পাগল করে দিয়েছিলপাঁচটি সেতার আনাতে গুনে গুনেমাথাপিছু ১৩ হাজার করে মোট ৬৫ হাজার টাকা খরচ হলোএখন দেখি ক্রেতাদের খবরনেইআর কি ধুলা পড়ে রে বাবা! দুই-তিন দিন অন্তর অন্তর কাচের শেলফে ধুলাজমে যায়! মৃত্যুঞ্জয় ছেলেটা ফাঁকিবাজবেশি কাজ করে নাইদানীং ছোকরারনতুন রোগ হয়েছে শাহবাগসন্ধ্যা ছয়টা থেকেই তার এই সায়েন্স ল্যাবরেটরিথেকে শাহবাগ যাওয়ার জন্য ছটফটানি শুরু হয়লাখ লাখ মানুষ দিন নেই রাতনেই, শুধু স্লোগান দিচ্ছেএই ছেলেমেয়েরা বরং সন্ধ্যাবেলাটা ধূপ-ধূনাজ্বালিয়ে তানপুরা হারমোনিয়াম কি সেতার-তবলা নিয়ে শুদ্ধ সংগীতের চর্চাকরলে তো পারে! মৃত্যুঞ্জয়কে আজ চোখে চোখে রাখেননিঠিক ছয়টা না বাজতেইদিয়েছে ছুটতাঁর এই ছোট্ট দোকানে তাঁরা তিনজন মাত্র মানুষতিনি, তাঁরকাকাতো ভাই কাম ম্যানেজার সুসেন গুপ্ত আর বরিশালের ছোকরা মৃত্যুঞ্জয়ফুট-ফরমাশ খাটেদোকান কুড়ায়, বাদ্যযন্ত্র সাজানো কাচের ডালাগুলোপরিষ্কার করে, সকাল-সন্ধ্যা বাদ্যযন্ত্রগুলোর সামনে ধূপকাঠি জ্বালায়এ তোঠিক ব্যবসা নয়, মা সরস্বতীরই সেবা প্রকারান্তরেসংসারের নানা চাপে নাহয় গায়ক হতে পারেননি রজত গিরিতাই বলে বীণাপাণির সেবা একটু করবেন না? নাহ্, রজত গিরি না হোক…রোদেলা তো গায়িকা হয়েছে! দেশের নামী গায়িকা!সবাই এক নামে তাকে চেনে
কয়টা বাজে? সাতটা ষোলোমৃত্যুঞ্জয় ফাঁকিদিয়ে শাহবাগ তো গেছেইসুসেনও বউকে নিয়ে একটু আগেই আজ বেরিয়েছেডেন্টিস্টের চেম্বারেতিনি একা শুধু তাঁর সুরের দোকানেছোটখাটো দোকানপাশেই মিউজিক্যাল রিদমসায়েন্স ল্যাবরেটরির এই বাদ্যযন্ত্রেরমার্কেটের…তিনি বলেন, ‘সুরের বাজার’… সবচেয়ে বড় দোকানমাসে প্রায়কোটি টাকার মুনাফা হয় না বিদ্যু বরণ সাহার? তাঁর প্রফিট মাসে এক কি দেড়লাখের বেশি নয়এতেই তিনি সুখী
আঙ্কেল…
কী?’
চেহারা থেকেইবুঝলেন, বড়লোকের উনিশ-কুড়ির তিন-চারটা ছেলেওরা একটা ব্যান্ড গ্রুপখুলতে চাইছেকয়েক সপ্তাহ ধরেই টুকটাক কিছু ইন্সট্রুমেন্ট কিনল ওরাএকটাকি-বোর্ড, দুটো বেজ গিটার, একটা ড্রামম্যালা টাকা এদের!
আঙ্কেল…গত সপ্তাহে কি-বোর্ডের হাফ পেমেন্ট করে গেছিলাম!
ওহ্’…ঈষপ্রসন্ন মনে ৯০ হাজার টাকার চেকটা নিলেন তিনিকাল সকালেই ব্যাংকে জমাদেবেন তিনিছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর একটু বিরক্তও বোধ হলোএদেরবাবা-মায়েরা এদের গানের জন্য এক লাখ ৮০ হাজার টাকার ইয়ামাহা কি-বোর্ডকিনে দেয়? শুধু টাকার শ্রাদ্ধ! পারবে এরা শুদ্ধ স্বরে পঞ্চম, ধৈব আরনিষাদ লাগাতে? কোমল গান্ধার আর কড়ি মধ্যম? পারবে নাকি-বোর্ড টিপেরেওয়াজ না করা গলায় বাংলিশ উচ্চারণে গাইবে, ‘ও আমার মুনিয়া-থুমি খেনোআশো না (তুমি কেন আসো না)?’ টিভিতে আজ রোদেলার একক সংগীতানুষ্ঠান আছেসন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়পঞ্চভাষ্করের গানরবীন্দ্র-অতুল-দ্বিজেন-নজরুল-রজনীকান্তএক ঘণ্টা ধরে দেখাবে দেশ টিভিতেএখন আর কোনো ক্লায়েন্ট এলে পাবে না তাকেবুকের ভেতর উত্তেজনা হচ্ছে কি? ভালোই হয়েছে, সুসেন আর মৃত্যুঞ্জয় নেই দোকানেকাঁপা হাতে দোকানেরসবচেয়ে বড় আলমারির ওপর তাকে রাখা টিভির সুইচ অন করে কাঁপা হাতে রিমোটটিপতে থাকেনজি বাংলা, ইনডিপেনডেন্ট, স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড, স্টারজলসাধ্যত্তেরি, দেশ টিভি আসতে এত দেরি করছে কেন? ওহ্, এই তো দেশ টিভি! যতরাজ্যের বিজ্ঞাপনের আর শেষ নেই
টিভির রিমোট দেশ’-এ রেখে ছোট্ট দোকানেরএক পাশে রাখা টেবিলে ফ্লাস্ক থেকে ঠান্ডা হয়ে আসা ঈষ গরম জলে চা-পাতাভিজিয়ে আর এক চামচ গুঁড়ো দুধ গুলিয়ে তাড়াতাড়ি এক কাপ চা বানিয়ে সিটেবসতে গিয়ে আবার উঠলেনঅনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে নতুন আনা সেতারগুলো একটুমোছা দরকার
তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে
আমার ভাঙল যা তা ধন্য হলো চরণপাতে
এইগানটা একবার তিনি আর রোদেলা গেয়েছিলেন না দ্বৈত সংগীত হিসেবে, জগন্নাথকলেজের অনুষ্ঠানে? সালটা ছিল ১৯৭৮রোদেলার সঙ্গে পরিচয় যেন কীভাবে হয়? রজত গুপ্তর বড় দিদি বীণাপাণির বান্ধবীর ছোট বোন ছিল না? বীণাপাণিগুপ্ত…আজ আয়েশা নাজনীন! সেটুকু হলেও চলতশুধু ওর শ্বশুরবাড়িটা যদি আরএকটু উদার হতো! আজকাল কত হিন্দু মেয়েই তো মুসলমান ছেলে বিয়ে করছে! দিদিকেএখন বোরকাও পরতে হয়কী অদ্ভুত গলা ছিল! হুট করে অমন রক্ষণশীল একটিপরিবারে বিয়ে না করলে অনেক বড় গায়িকা হতে পারতবড়দির বান্ধবী সিতারাপারভীন

বা সিতারা আপাদের বাড়ি ছিল ওয়ারী র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিটরজতগুপ্তরা থাকত শাঁখারীবাজারে১৯৭৩ সালের এক সরস্বতী পূজার দিন সিতারা আপারোদেলাকে নিয়ে এসেছিলেনসিতারা পারভীনের ছোট বোন রোদেলা পারভীন
বীণা!আমার এই বোনটা খুব গানপাগলকিন্তু আব্বা গান একদম পছন্দ করে নাওর গলাখারাপ নাআম্মা অবশ্য চায় ও গান শিখুকআম্মা লুকিয়ে খরচ দেবেতোরস্যারের কাছেই যদি যায়?’
অনিল ঘোষ স্যারকে তো বলতেই পারি! কিন্তু শুধু ক্লাসে শিখলেই তো হবে নাবাসায়ও তো প্র্যাকটিস করা লাগবে
সেহবেআব্বা ব্যবসার কাজে কত যেন আর বাসায় থাকে? তারপর বিজনেসের কাজে আজএই শহর কি কাল ওই শহর, আজ এই দেশ কাল ওই দেশ তো আছেইতুই শুধু আমারবোনটাকে দেখিস!
রজত গুপ্তর বাবা শিবশঙ্কর গুপ্তর একটি ছোটখাটোমিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের দোকান ছিল শাঁখারীবাজারেইতখন এই গোটা মিউজিকমার্কেটই ছিল শাঁখারীবাজারেবাহাত্তর সালেই অবশ্য মার্কেট চলে এল সায়েন্সল্যাবেদোকানও তখন থেকেই সায়েন্স ল্যাবে শিফটবাবার দোকানের আয়ে দুইবোন আর সে ছোট ভাই…তিন ভাইবোন, মা আর বাবাপাঁচজনের সংসার ভালোই চলতবড়দিদি অদ্ভুত গান গায়জগন্নাথ কলেজে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারমেজো দিদিঅঙ্কে খুব ভালো মাথাভালো ছাত্রীগলায় সুর নেইরজতকে সবাই বলে মেয়েলিসুন্দরফরসা আর কাটা কাটা নাক-চোখতারও গানের গলা ভালোতারা দুইভাইবোনই অনিল ঘোষ স্যারের বাসায় ক্লাস করতে যায় প্রতি রোববার আরবৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ধীরে ধীরে তাদের প্রতি সপ্তাহের দুই সন্ধ্যারক্লাসে ঢুকে গেল রোদেলা পারভীনসন্ধ্যার ক্লাস শেষে ১৪ বছরের রোদেলাকেসূত্রাপুর থেকে র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিট পৌঁছে দেওয়ার চাকরিও জুটল সতেরোররজতেরকখনো রিকশায়, কখনো হেঁটেএই চাকরি চলল পরবর্তী পাঁচ বছর
আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমণির হারে,
বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে
আরে…রোদেলাপারভীন আর গান পেল না? সে বেছে বেছে এই গানটা দিয়েই শুরু করল? সে কী করেজানে যে আমি রজত গিরি গুপ্ত, বয়স ৫৭, আজ সারা দিন কলকাতা থেকে আনাসেতারগুলো দেখে থেকে থেকে এই গানটিই গুনগুন করছি?
তুমি কোলে নিয়েছিলে সেতার, মিড় দিলে নিষ্ঠুর করে—’
রোদেলাপারভীন…তোমাকে চুলে এমন পাক ধরলে বুঝি ভালো লাগে? মুখে এমন কড়া মেকআপ? তবে এখনো তেমন মোটা হওনি তুমিসেই ১৪ বছরের কিশোরীর ত্বকে এমন কুঞ্চনসেসবও সহ্য হতোকিন্তু তোমাকে নিয়ে বাজারে এত এত কুসিত কথা, ভালো লাগেনা আমার! এই রজত গিরি গুপ্তের! উনআশি সালের সেই সন্ধ্যায় তুমি জোর করেআমাকে নিয়ে ছুটলে বুড়িগঙ্গায়…নৌকায় উঠে চৈত্রের হু হু হাওয়ায় আমারহাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বললে, ‘আম্মা বলছে তোমার শুধু কাগজ-কলমেএকবার মুসলিম নাম লিখলেই হবেআর কিচ্ছু করা লাগবে নানামাজ-রোজা কিচ্ছুকরতে হবে না! আব্বার মেজাজ তো জানো!
আমি থমকে গিয়ে বললাম, ‘বড় দিদিরঅমন কাণ্ডের পর বাবার প্যারালাইসিস স্ট্রোক আজ দুই বছরতুমি তো সব জানো, রোদেলাআমাকে ক্ষমা কোরো! সম্ভব না!
তুমি অনেকক্ষণ কাঁদলেতারপরচিকার করে বললে, ‘ইতর! স্কাউন্ড্রেল…কাওয়ার্ড! লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমকরার মজা নেবা, বিয়া করবা না? আমি আব্বারে বলব ওই আর্মি অফিসাররেই আমিবিয়া করব!
শোনো, আমি মুসলমান হইলেও সম্ভব ছিল নাবাবার এই অবস্থা!দোকানে বসতে হচ্ছেব্যবসা করতে গিয়া যা বুঝতেছি, আমার গান হবে না! কিচ্ছুহবে না!
ব্যস…এনাফ ইজ এনাফ! আমার আর কিচ্ছু শোনার দরকার নাই!
তারপর? মেজর শামসুদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে উনিশে তোমার বিয়ে হলোবিয়ের কার্ড দিয়েগেছিলে আর আমার মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে, হাসি-হাসি মুখেবলেছিলে, ‘খালাম্মা, দোয়া করবেনমেজদির বিয়ে হয়ে গেল ইন্ডিয়ায়বড়বোনের সঙ্গে খোঁজখবর নেইবাবা বিছানায় পড়ে থাকেনআর আমি…রজত গিরিগুপ্ত অনিল ঘোষ স্যারের ক্লাসে রাগ দুর্গা, আহীর ভৈরব আর হংসধ্বনির মায়াকাটিয়ে মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের দোকানে পড়ে থাকিবিয়ের তিন মাসেরমাথায় আমাদের বাসার সাদা-কালো টিভিতে তোমার প্রথম গানের অনুষ্ঠান দেখলাম, ছয় মাসের মাথায় হলুদ খামে পাঠানো একটি চিঠিতে তোমার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ারসংবাদ আর তারও ছয় মাস পর সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থানে তোমার বৈধব্যের খবর
তারপরদ্বিতীয় বিয়েএবারের স্বামী ব্যবসায়ীচুরাশি সালের কথাএকই সালেআমারও প্রথম ও একমাত্র বিয়ে জনৈকা শেফালিকা করের সঙ্গেতোমাররবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে উত্থানআরও উত্থানকিন্তু আজকাল এসব কীশুনি? তোমার ব্যবসায়ী স্বামী আরেক জায়গায় বিয়ে করেছেতুমি আর এক মেজরজেনারেলের সঙ্গে…স্ত্রী হিসেবে নও…ভগবান, এসব কথা মিথ্যা হোক!
এইবসন্তে বৃষ্টি নামবে নাকি? উহু…দীপক রাগাশ্রয়ী রজনীকান্তের এই গানটিরআভোগে উঠতে গিয়ে সুরে লাগল নাগলা তোমার খারাপ নারেওয়াজে ছিলে বরাবরফাঁকিবাজতালে ছিলে একটু কাঁচাএকবার অনিল স্যারের হুকুমে তোমার নীলচুড়ি পরা ফরসা হাতের মুঠি আমাকেই ধরে তাল শেখাতে হয়েছিলওস্তাদজিতানপুরায় ধরেছিলেন রাগ দুর্গার বন্দেশ:
বাদরবা বরখন লাগে মেহারবা
কারী ঘটাঘন বিজুরী চমকবা
আলম পিয়া পরদেশ গমনবা
একা ড্যর পাঁউ ম্যায় নাহি সঙ্গবা
জিয়া নাহি মানত কা করুঁ সজনবা।।
তারপরের সকালে তুমিই প্রথম চিঠি দিয়েছিলে আমাকেআকাশে বিদ্যু চমকাচ্ছে, রোদেলাসাবধানে থেকো

 

 

 

১ মার্চ, ২০১৩,

 

শেয়ার করুন