ডেস্ক রিপোর্ট: ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে পুলিশ। সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে না। বিরোধীরা রাজপথে নামলেই মুহুর্মুহু গুলি, টিয়ারশেল নিক্ষেপ, গ্রেনেড হামলা ও বেধড়ক লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আটকের পর খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করছে। গত ১১ দিনে পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৭ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির, স্বেচ্ছাসেবক দল, মুসল্লি ও সাধারণ জনগণ রয়েছেন। পুলিশের ছোড়া গুলিতে কয়েকশ’ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিত্সাধীন অবস্থায় রয়েছেন। আটক হয়েছেন অনেকে।এছাড়া কয়েক জনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের গুম করা হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে উদ্বিগ্ন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা।
গত কয়েক দিনের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আন্দোলনকারী বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মুসল্লিদের ওপর পুলিশের গুলিতে নিহত ১৭ জনের মধ্যে চারজনই মানিকগঞ্জের। এছাড়া সিলেটে তিনজন, কক্সবাজারে চারজন, পাবনায় দুইজন, গাইবান্ধায় তিনজন ও কুমিল্লায় একজন নিহত হয়েছেন। পুলিশের গুলিতে আহত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি চিকিত্সাধীন রয়েছেন। এ সময় বেশ কয়েকটি নৃশংস ঘটনার ছবি ও ভিডিও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি বিরোধীদের ওপর পুলিশের অমানবিক নির্যাতনের একটি ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ছাড়া হয়েছে। ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, কক্সবাজারে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে কক্সবাজার শহরে ‘সাঈদী মুক্তি পরিষদ’ আয়োজিত সব স্তরের মানুষের মিছিলে পুলিশ নির্বিচার গুলি চালাচ্ছে ও বেধড়ক লাঠিচার্জ করছে। একপর্যায়ে দুইজন যুবককে আটক করে কয়েকজন পুলিশ সদস্য বেধড়ক পেটাচ্ছে। একপর্যায়ে লাল-সাদা রঙের শার্ট পরা যুবকটি রাস্তার পাশের একটি খোলা রুমে আশ্রয় নিলে সেখানে পুলিশের ৪-৫ জন সদস্য তাকে প্রহার করতে থাকে। একপর্যায়ে খুব কাছ থেকে এক পুলিশ সদস্য ওই যুবককে গুলি করে। কিছু সময় পরই যুবকের নিস্তেজ দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওই যুবকের লাশ আর পাওয়া যায়নি। গত ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ইসলামি দলগুলোর ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশে অবিরল গুলি চালাতে থাকে পুলিশ। বিভিন্ন টেলিভিশনে সম্প্রচারিত খবরে দেখা গেছে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের ওভারব্রিজে পাঞ্জাবি পরিহিত এক যুবককে কয়েকজন পুলিশ সদস্য বেধড়ক মারধরের একপর্যায়ে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ যুবকের পিঠ থেকে অঝরে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। সে অবস্থাতেও কয়েকজন পুলিশ তার নাকে-মুখে লাথি মারতে থাকে। এসব বিষয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মানিকগঞ্জে আলেমসহ নিহত ৪ : ইসলাম ধর্ম অবমাননা ও হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করার প্রতিবাদে ইসলামি দলগুলোর ডাকে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রোববারের হরতালে পুলিশের গুলিতে মাদরাসা শিক্ষকসহ ৫ জন নিহত হয়েছেন।গুলিবিদ্ধ হয়েছে নারী-শিশুসহ ২০ জন। প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীরা জানান, হরতাল সমর্থনে সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে আসেন। তারা সিংগাইর-মানিকগঞ্জ সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে স্লোগান দেন। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ হয়। এলাকাবাসীকে লক্ষ্য করে পুলিশ কয়েকশ’ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে।এতে চারজন নিহত হন। তারা হলেন গোবিন্দল মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ শাহ আলম (২৫), নাজিম উদ্দিন (২৬), আলমগীর (২৫) ও মাওলানা নাসির উদ্দিন (৩০)।মানিকগঞ্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আলী মিয়া ওইদিন সাংবাদিকদের জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫০ রাউন্ড টিয়ারশেল এবং ৩০০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়।
সিলেটে ৩ জন নিহত : সিলেটে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ও গত ২২ ফেব্রুয়ারি মিছিলে পুলিশের গুলিতে আহত দুই তগুণের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে সিলেটে তিনজন নিহত হয়েছেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সিলেটে সাঈদী মুক্তি পরিষদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে আহত মহানগর শিবিরের সহ-সমাজসেবা সম্পাদক আলী আজগর খান রাহাত গত সোমবার ঢাকায় চিকিত্সাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। এছাড়া শুক্রবার চৌহাটায় তৌহিদি জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিতে আহত সুহিনকে রোববার রাত ১১টা ২০ মিনিটে সিওমেক হাসপাতালে মারা যান। ওই দিন পুলিশের নির্বিচার গুলিতে মোস্তফা মুর্শেদ তাহসীন (১৮) নামে এক যুবক নিহত হয়। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি চৌহাট্টায় শিবিরের মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ছোড়ে পুলিশ। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন রাহাত। তিনি সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র। তার লিভারে গুলি লেগেছিল। নিহতের বাবা নুরুল মোস্তফা জালালাবাদ গ্যাসে কর্মরত। এমসি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র তাহসীন জুমার নামাজ শেষে হাউজিং এস্টেট মসজিদ থেকে মুসল্লিদের মিছিলে অংশ নেয় এবং চৌহাট্টায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। এ সময় কমপক্ষে ৫০ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত হন।
কক্সবাজারে ৪ জন : গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে কক্সবাজার শহরে সাঈদী মুক্তি পরিষদ আয়োজিত সব স্তরের মানুষের মিছিলে পুলিশ নির্বিচার গুলি চালায়। গুলিতে চারজন নিহত ও দেড় শতাধিক গুলিবিদ্ধ হন। নিহতরা হলেন সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের জামায়াতকর্মী নুরুল হক (৪২), পিএমখালী ইউনিয়নের মোক্তার আহমদের ছেলে মোহাম্মদ আবদুল্লাহ (৪২), শহরতলীর গোদারপাড়ার কলিম উল্লাহর ছেলে শিবিরকর্মী তোফায়েল উদ্দিন (২২) ও ছালেহ আহমদ (৪৫)।
পাবনায় ২ জন : গত ২৩ ফেব্রুয়ারি পাবনায় জামায়াতের ডাকা অর্ধদিবস হরতাল চলাকালে পুলিশের গুলিতে দুই জামায়াতকর্মী নিহত হয়। নিহতরা হলো ধর্মগ্রাম এলাকার শমশের আলীর ছেলে আলাল হোসেন (১৮) ও মনোহরপুর এলাকার আবদুল কুদ্দুসের ছেলে সিরাজুল ইসলাম (২৩)। গুলিবিদ্ধ আরও ২ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
গাইবান্ধায় ৩ জন : গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইসলাম ও নবী (সা.)-এর অবমাননার প্রতিবাদ ও ধর্মদ্রোহী নাস্তিক, মুরতাদদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ফুঁসে ওঠা ইসলামি জনতার মহাজাগরণ দমাতে নির্বিচার গুলি চালালে গাইবান্ধায় তিন মুসল্লি নিহত হন। এরা হলেন গোবিন্দপুরের মোমিন ও মুঞ্জু এবং মহদিপুর ইউনিয়নের কোকিল। এছাড়া ২৫ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় অন্তত ৫০ জন। শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে সমমনা কয়েকটি ইসলামী দলের কয়েক হাজার লোক মিছিল করে রংপুর-বগুড়া মহাসড়ক অবরোধ করলে পুলিশ বিনা উসকানিতে ৩০ রাউন্ড গুলি চালায়। এতে ২ জন ঘটনাস্থলে এবং হাসপাতালে নেয়ার পথে মোমিন নামে আরও একজন মারা যান। এ সময় কমপক্ষে ২০ জনকে আটক করে পুলিশ।
কুমিল্লায় একজন : গত ১৮ ফেব্রুয়ারি হরতালের সময় কুমিল্লায় জাময়াত-শিবির কর্মীদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ইব্রাহীম নামে এক জামায়াতকর্মী নিহত হন।গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে তার মৃত্যু হয়। এ সময় তিনজন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় আরও ২৫ জন।
২৭ফেব্রুয়ারী/নিউজরুম