একটা সময় ছিল যখন বাংলা চলচ্চিত্রে খুরশীদ আলমের গান ছিল অপরিহার্য। সে সময়এখন আর নেই। কিন্তু সেই খুরশীদ আলম আজও আছেন, আজও গান করছেন। কেমন আছেনতিনি? বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাদিহা মাহনূর
স্বর্ণযুগে খুরশীদ আলমের গান ছিল চলচ্চিত্রের প্রাণ। তার গান মানেইশ্রোতা-দর্শকের মনে এক অন্যরকম দ্যোতনা সৃষ্টি করত। স্বর্ণযুগের নায়কদেরমধ্যে শুধু ফারুক ছাড়া আর সবার কণ্ঠে বেশ সাবলীলভাবেই শোভা পেত খুরশীদআলমের গান। বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রে ডা. আবু হায়দারসাজেদুর রহমানের লেখা ‘বন্দী পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে’—গানটি দিয়েইপ্লে-ব্যাকে খুরশীদ আলমের যাত্রা শুরু হয়। সময়টা ছিল ১৯৬৯। এই গানটিনায়করাজ রাজ্জাকের লিপে গিয়েছিল। এক গান দিয়েই জয়পুরহাটের ছেলে খুরশীদ আলমচলচ্চিত্রের শ্রোতা-দর্শকের মন জয় করে নেন। সেই থেকে শুরু হলো চলচ্চিত্রেখুরশীদ আলমের সফল সঙ্গীত জীবন। তারও আগে ১৯৬৭ সালে তত্কালীন বেতারে আধুনিকগানের তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে শুরু হয় তার পথচলা। সে সময় খুরশীদ আলমেরগাওয়া দুটি আধুনিক গান কবি সিরাজুল ইসলামের লেখা ‘তোমার দু’হাত ছুঁয়ে শপথনিলাম’ এবং জেবুন্নেসা জামালের লেখা ‘চঞ্চল দু’নয়নে বল না কি খুঁজছি—ব্যাপকশ্রোতাপ্রিয়তা পায়। এখন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচশ’ চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেনখুরশীদ আলম। তিনি বলেন, ‘আগন্তুক’ দিয়ে শুরু আমার। এরপর রবিন ঘোষের সুরে‘পিচঢালা পথ’, ইআর খানের ‘সাধারণ মেয়ে’ থেকে যে শুরু হলো, তা শেষ হয়নায়করাজ রাজ্জাকের ‘কোটি টাকার ফকির’ ছবিতে গান করে। এখন অনেক ছবিতে গানগাওয়ার অফার পাই। কিন্তু গানের কথা যেমন ভালো লাগে না, সুরও ঠিক তেমন কানেবা হৃদয়ে দোলা দেয় না। সত্যি বলতে কি, একটা অসাধারণ সময় আমরা পার করেএসেছি। খুব সুরেলা একটা সময় আমরা পার করে এসেছি। স্বর্ণযুগ পেছনে ফেলেএসেছি আমরা। সেই সময় মনে হয় আর ফিরবে না। তবে তরুণ কিছু ছেলে চেষ্টা করছেভালো করার। তারাও আবার নানাভাবে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন।’ জয়পুরহাটেখুরশীদ আলমের জন্ম হলেও পুরনো ঢাকাতেই তার বেড়ে ওঠা। চাচা ড. আবু হায়দারসাজেদুর রহমানের কাছেই মূলত তার গানে হাতেখড়ি। এরপর শেখ আবুল ফজল, জায়েদুররহিম, শেখ লুত্ফর রহমান, আমিনুল ইসলাম শারকী এবং ওস্তাদ বারীন মজুমদারেরসঙ্গীত বিদ্যালয়ে গানে তালিম নিয়েছিলেন তিনি। তবে তার কণ্ঠ বিশেষ কারও মতোমনে হতো বলে পরবর্তী সময়ে ছায়ানটে তার কণ্ঠের নিজস্বতা আনতে সহায়তাকরেছিলেন বরেণ্য সঙ্গীত পরিচালক আজাদ রহমান। একজন খুরশীদ আলম সবসময় শুধুগানই গেয়েছেন। সঙ্গীত পরিচালনায় তাকে কখনোই পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে তিনিবলেন, ‘আমি কণ্ঠশিল্পী। গীতিকবিতাকে নিজের কণ্ঠে ধারণ করাই আমার কাজ। সুরনিয়ে ভাবা বা সুর সৃষ্টি করা আমার কাজ নয়। যখন আমি সঙ্গীত পরিচালনার কাজশুরু করব—তখন কিন্তু আমি অন্য আরেক সঙ্গীত পরিচালকের প্রতিযোগী হয়ে উঠব।যেমন মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী ভাই ভালো গান করতেন, কিন্তু পরে যখন তিনিসঙ্গীত পরিচালক হলেন, তখন কিন্তু অনেকের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন। কমে গেলতার গান। তাই আমি আমার গান গাওয়া নিয়েই সবসময় ভেবেছি। গাওয়া ছাড়া অন্যকিছুনিয়ে ভাবিনি। যে কারণে অন্য কোনো ক্ষেত্রে আমাকে একেবারেই পাওয়া যায়নি।’ অনেক চলচ্চিত্রে গান গাইলেও এখনও গুণী এই শিল্পী কোনো জাতীয় পুরস্কারেভূষিত হননি। এমনকি মিলেনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অবশ্য পুরস্কারের আশায়তিনি প্লে-ব্যাক করেননি। জীবনের প্রয়োজনে, নিজের ভালো লাগা আরশ্রোতা-দর্শকের কথা চিন্তা করেই তিনি গান গেয়েছেন একের পর এক। কোন গান কীপুরস্কার এনে দিবে—এটা নিয়ে তার মাঝে তেমন কোনো ভাবনাই ছিল না। খুরশীদ আলমবলেন, ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাইনি—এ নিয়ে কখনোই আমার দুঃখও হয় না।কারণ আমি জানি, এ দেশ প্রকৃত অর্থে গুণীর কদর করতে শেখেনি। আমার সরাসরিশিক্ষক ছিলেন অজিত গুহ। তিনি প্রয়াত হয়েছেন আজ থেকে ২০ বছর আগে। অথচ তাকেদেয়া হয় মরণোত্তর সম্মাননা। ঠিক এমনই সম্মাননা আরও অনেককেই দেয়া হয়। এটাকোন ধরনের ভণ্ডামি আমি বুঝি না। আমার আজও মনে আছে গোলাম মুস্তাফা ভাইকেএকবার পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।তিনি অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে মঞ্চে উঠে সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানকরেছিলেন। মুস্তাফা ভাইয়ের মতো এমন সাহসী মানুষ আমি দেখিনি আজও। তো যেবিষয়টি বলতে চাচ্ছি, সেটা হলো— এখানে সত্যিকারের গুণী মানুষের কদর করা হয়না। তাই এ ধরনের স্বীকৃতিকে আমি ঘৃণা করি। কারণ, যারা জুরিবোর্ডে থাকেনতারা নিজেরাই তো শুদ্ধ নন। তারা আমার বিচার করবেন কী করে!’
২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩.