শুরুতে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ভাষা আন্দোলনের মাসে ভাষা নিয়ে গবেষণা এবং তথ্যমূলক বিষয় লেখার জন্য। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষা নিয়ে লেখার জন্য। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি ভাষা নিয়ে লেখা শুরু করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর আগে ককবরক, গারো, আরবি, উর্দু, মারমা, মণিপুরি ও ইংরেজি ভাষা নিয়ে লেখা লেখেন। তাঁর এই ভাষা নিয়ে লেখাগুলো আমি মন দিয়ে পড়েছি একটা আলাদা আগ্রহ নিয়ে। কারণ, ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফের অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম মৌলিক শিক্ষা কার্যক্রমের ‘তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার/বর্ণে’ তঞ্চঙ্গ্যাভাষী শিশুদের জন্য প্রিপ্রাইমারি-১, ২ এবং গ্রেড-১ নিয়ে উপকরণ তৈরির কাজের সঙ্গে দুই বছর যুক্ত থাকার আমার সৌভাগ্য হয়েছে। তাই আমি শুধু তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা নিয়ে পাঠ-প্রতিক্রিয়া করব। হাবিবুর রহমান তাঁর লেখায় তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস নিয়ে লিখেছেন। তারা মূলত রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলায় বসবাস করে। বিষয়টি পুরোপুরি সত্য নয়। তঞ্চঙ্গ্যারা ওই দুটি জেলা ছাড়াও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলা (রাঙ্গুনিয়া), কক্সবাজার ও টেকনাফ অঞ্চলে বসবাস করছে। তবে কক্সবাজার ও টেকনাফে তারা নামের শেষে বা শেষ অংশে ‘চাকমা’ পদবি ব্যবহার করে। তারা চাকমা পদবি ব্যবহার করলেও নিজেদের তঞ্চঙ্গ্যা হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে; আর কথা বলে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ‘মুঅ গছা’দের আদলে। এ ছাড়া তঞ্চঙ্গ্যারা ভারতে মিজোরাম, ত্রিপুরা, আসাম, অরুণাচল প্রদেশে বসবাস করে। তারা সেখানে ‘তঞ্চঙ্গ্যা চাকমা’ নামে বসবাস করে এবং তাদের সেখানে ‘দাইনাক/তঞ্চঙ্গ্যা চাকমা’ নামে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও আছে। হাবিবুর রহমান ‘চাকমা’ পর্বে ৮ ফেব্রুয়ারি চাকমাদের একটি শাখা ‘দইংনাক’ (লেখা হয় দাইনাক) নামে মিয়ানমারের রয়েছে বলে যে মত দেন, তারা আসলে চাকমাদের অংশ নয়, তারা তঞ্চঙ্গ্যাদের অংশ। দাইনাক যে তঞ্চঙ্গ্যাদের একটি অংশ এটি ইতিহাসের সত্যতা রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যা নামটি উৎপত্তি হয় তৈনগাঙ নামক একটি শঙ্খ নদের উপনদ থেকে। যে উপনদটি বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় অবস্থিত। ইতিহাস বলে, তঞ্চঙ্গ্যারা যখন আরাকান তথা বার্মা থেকে এই দেশে আসে, তখন তারা সর্বপ্রথম এই তৈনগাঙের পারে তৈনছড়িতে বসতি স্থাপন করে। হাবিবুর রহমান তাঁর লেখায় লিখেছেন অনেকের মতে, তঞ্চঙ্গ্যারা চাকমা জাতির অন্তর্ভুক্ত একটি উপগোত্র এবং একই বিষয় নিয়ে ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইনের লেখাও রেফারেন্স টেনেছেন, টি এইচ লুইনের তথ্যটি সত্য নয়। সেটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন গবেষণামূলক লেখায় লেখা হয়েছে। কারণ, চাকমাদের যে ৪৬টি উপগোত্র আছে, সেখানে ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ নামে কোনো গোত্র নেই। আর চাকমা প্রবীণ ব্যক্তিরা মনে করেন, বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা নাকি আসল চাকমা। আমি ব্যক্তিগতভাবে পাঁচ-ছয়জন চাকমা প্রবীণ ব্যক্তি থেকে এই কথাগুলো শুনেছি, এটি গবেষণার বিষয়। সে জন্য আমি আমার একটি প্রবন্ধে (তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চা একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ‘গৈরিক’ ২৫৫৫তম বুদ্ধজয়ন্তী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ ছাত্র পরিষদ রজতজয়ন্তী ২০১১ বিশেষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৯৬, সম্পাদক: বিশ্বলাল তঞ্চঙ্গ্যা) লিখেছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস আরও নতুন করে লেখা দরকার। তঞ্চঙ্গ্যা আর চাকমা ভাষার মধ্যে উচ্চারণগত পার্থক্যের পাশাপাশি প্রয়োগগত পার্থক্য রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা মোট ৩৬টি। স্বরবর্ণ পাঁচটি আর ব্যঞ্জনবর্ণ ৩১টি। আর চাকমাদের মোট বর্ণমালা ৩৯টি, তার মধ্যে ৩২ ব্যঞ্জনবর্ণ আর স্বরবর্ণ সাতটি। তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালার সঙ্গে চাকমা বর্ণমালার সাতটি বর্ণ অমিল রয়েছে। অমিল বর্ণগুলো হচ্ছে: খা, ঙা, ঝা, টা, ঠা, ণা আর দা। মারমা বর্ণমালার সংখ্যা ৪৫টি। তার মধ্যে ৩৩টি ব্যঞ্জনবর্ণ আর বাকি ১২টি স্বরবর্ণ। এই ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে ১০টি তঞ্চঙ্গ্যা ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে মিল রয়েছে। বাকি ২৩টি বর্ণের মিল নেই। তবে সংখ্যা গণনায় তঞ্চঙ্গ্যা ও মারমার মিল রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা বর্ণমালার লিখিত রূপ এবং উচ্চারণ আ-কারান্ত। যেমন: কা, খা, গা, ঘা, ঙা। লিখিত এবং উচ্চারণগত রূপ আ-কারান্ত হলেও তঞ্চঙ্গ্যাদের লিখিত এবং কথ্যরূপ আ-কারান্ত হলেও চাকমাদের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। চাকমারা লেখার সময় লেখে আ-কারান্ত কিন্তু বলার সময় বলে এ-কারান্ত; আর তঞ্চঙ্গ্যারা বলে লিখিত এবং কথ্যরীতির মধ্যে ভিন্নতা নেই। যেমন: খেইম (চাকমা), খাইন্ (তঞ্চঙ্গ্যা)-এর বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘খাব’। তঞ্চঙ্গ্যারা একসময় দাইনাক পরিচয়ে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে তঞ্চঙ্গ্যা পদবি ধারণ করে। কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা রাঙামাটি। ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: