২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩: ফি বছর একুশে বইমেলায় তরুণ-তরুণীর ঢল নামে, সেই ঢল উপচে পড়ে ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি অবধি। এ বছর সেই দৃশ্য অবশ্য পুরোনো ফ্রেমে আটকেথাকেনি, ঢল গিয়ে থেমেছিল শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে। সেই ঢেউয়ের উন্মত্ততাটের পাওয়া গেল ২০ ফেব্রুয়ারিতেও। সন্ধ্যার আগ-মুহুর্তে আমরা যখন ঢুকছি বইমেলায় তখন বাংলা একাডেমীর প্রধান ফটকের সামনেই দেখা হলো জাহাঙ্গীরনগরবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাসির উদ্দিনের সঙ্গে যিনি কেবলই এসেছেনবইমেলায়। ‘মেলায় এসেছি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কবিতা ও গল্পের কোনো সংকলন পাইকি না, তার খোঁজে।’ বললেন নাসির। কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করি, ‘শুধু কবিতারবই-ই পড়েন?’
‘না, না…’ ঝটপট বলতে শুরু করেন নাসির, ‘আমি অনেকটা সর্বভুক পাঠক। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ থেকে শুরু করে সব ধরনের বই পড়ি।’
নাসিরেরকথা শেষ হতে না-হতেই আমাদের সামনে ঘটে যায় এক নাটক। ‘আরে নাসির!’ বলেএকগাদা বইসহ এক তরুণ বুকে টেনে নেন নাসিরকে। ‘আরে বায়েজিদ! তুই কবে ঢাকায়এসেছিস, বলিসনি তো?’ বলে নাসিরও তৎক্ষণাৎ শামিল হন এই মঞ্চে।
খানিকবাদে জানা গেল, নাসিরের শৈশবের বন্ধু বায়েজিদ এসেছেন রাজশাহী থেকে। তিনিপড়ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘প্রতিবছরই বইমেলায় আসি আমি। এবার একটুআগেভাগে এসে পড়েছি আন্দোলনে একাত্ম হওয়ার জন্য।’ বলছিলেন হিসাববিজ্ঞানবিষয়ে স্নাতক পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী। তারপর বন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘লিটনকে চিনিস তো; ওই যে আমাদের সঙ্গে স্কুলে পড়ত, এখন চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, সে-ও এসেছে চট্টগ্রাম থেকে।’
‘তাই নাকি? আমাকে তোরা কেউ জানাসনি।’ স্পষ্ট অভিমান নাসিরের গলায়।
‘জানাব কী করে? তোর মুঠোফোন তো সব সময় বন্ধ থাকে?’
‘বন্ধ থাকে মানে? আমার নতুন নম্বর তুই জানিস না?’
দুইবন্ধুর মধুর মৃদু ঝগড়া থেকে এবার বিনয়ের সঙ্গে বিদায় চাই। তারপর আবারহারিয়ে যাই মেলার ভিড়ে। হাজার হাজার তরুণমুখের সম্মেলন এখানে। সবাই ঘুরেঘুরে বই পছন্দ করছেন। কিনে নিচ্ছেন দুই হাত ভরে। কেউ কিনছেন নিজেরব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার জন্য, কেউ কিনছেন প্রিয় মানুষকে উপহার দেওয়ারজন্য। এমনই একজনের সাক্ষাৎ মিলল বাংলা একাডেমী বিক্রয়কেন্দ্রের সামনে।তিনি মেহেদী হাসান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী মেলার প্রথমদিন থেকেই বই কেনা শুরু করেছেন। প্রতিদিনই একটি-দুটি করে বই কিনছেন। ‘আমিশুধু ফেব্রুয়ারি মাসে বই কিনি আর বিলি করি বছরব্যাপী।’ হাসতে হাসতে বললেনতিনি। ‘মানে?’ বিষয়টি খোলাসা করতে অনুরোধ করি আমরা। তিনি তখন বলতে শুরুকরেন, ‘প্রতি মাসেই কোনো না কোনো বন্ধুর জন্মদিন থাকে। তাদের জন্মদিনে আমিশুধু বই উপহার দিই। আর যেসব বই উপহার দিব বলে মনস্থির করি সেসব বই কিনি বইমেলা থেকে।’
তাঁকে শুভকামনা জানিয়ে সামনে পা বাড়াই।
বাংলা একাডেমীরবর্ধমান হাউসের সামনের পুকুরপাড়ে পেয়ে যাই স্নিগ্ধা, আনু, মিলু, রিতু ওফেরদৌসীকে। ইডেন মহিলা কলেজে পড়ুয়া এই পাঁচ বন্ধু এসেছেন তাঁদের আরেকবন্ধু মৌসুমীর বই কিনতে। ‘মৌসুমী আমাদের লেখক-বন্ধু। অনেক দিন ধরেপত্রপত্রিকায় গল্প-কবিতা লিখলেও এবারই প্রথম তার বই প্রকাশিত হয়েছে। তাইআমরা দল বেঁধে তার বই কিনতে এসেছি। হলে গিয়ে ওর কাছে অটোগ্রাফ চেয়ে চমকেদেব।’ বলছিলেন এই দলের স্নিগ্ধা।
ভিড় ঠেলে আরও সামনে এগোই। অগণিততরুণ-তরুণী যেমন হেঁটে বেড়াচ্ছেন, তেমনি ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন স্টলেস্টলে। তাঁদের কেউ কেউ স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পাতা ওল্টাচ্ছেন প্রিয় লেখকহুমায়ূন আহমেদের কোনো বইয়ের তো, কেউ কেউ ফ্রানৎজ কাফকার অনুবাদের।বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, প্রেমের কবিতা, শিশুতোষ বই, প্রবন্ধ বা গবেষণাধর্মীবইও হাতে তুলে নিচ্ছেন কেউ কেউ।
একজনকে দেখা গেল শহীদজননী জাহানারাইমামের একাত্তরের ডায়েরি বইয়ের পাতা ওল্টাতে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসু চোখেতাকাতেই তিনি বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার; আমার সবচেয়ে আগ্রহেরবিষয়। তাই খুঁজে খুঁজে আমি মুক্তিযুদ্ধের বই বেশি কিনি।’
ফেব্রুয়ারিমাস মানেই তিন উৎসব—বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।এবার মধ্য ফেব্রুয়ারিতে যোগ হয়েছে সরস্বতী পূজাও। উৎসব মানেই তো উপহার।সেই উপহারের তালিকায় সবার ওপরে থাকে ‘বই’। বইয়ের চেয়ে ‘সেরা উপহার’ আরকী হতে পারে?
সময় গড়াতে থাকে আর বইমেলায় পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকেতারুণ্যের ভিড়। স্রোতের মতো সেই ভিড়ে এবার আমি পা বাড়াই নিজের পছন্দেরবইয়ের খোঁজে।