ডেস্ক রিপোর্ট: মহান আল্লাহ ও রাসুল (স.)-কে নিয়ে ব্লগে কিছু নাস্তিকের কুরুচিপূর্ণ লেখালেখির প্রতিবাদ এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সারাদেশের মতো গতকাল ১২টি ইসলামী দলসহ সাধারণ মুসল্লিরা চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও বগুড়ায়ও মিছিল বের করেন। চট্টগ্রামের পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে মুসল্লিদের গণবিস্ফোরণ ঘটে। তবে রাজশাহী, খুলনা, পাবনা, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মুসল্লিদের ওপর পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডাররা হামলা চালায়। মিছিল বের করার আগেই এসব এলাকায় মুসল্লিদের মোকাবিলা করতে যৌথভাবে রণপ্রস্তুতি নেয় সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশ। মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ তিন জায়গায় দেড় শতাধিক মুসল্লি গুলিবিদ্ধসহ কয়েকশ’ আহত হয়েছেন। আমাদের অফিস ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
চট্টগ্রামে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে গণবিস্ফোরণ : ইসলামের ১ হাজার ৫শ’ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন অবস্থা পার করছে। আবু জাহেল, আবু লাহাবরাও আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে (সা.) যে ভাষায় অপমান করতে সাহস করেনি, তার চেয়ে জঘন্য ভাষায় শাহবাগের আন্দোলনকারীরা অপমান করেছে। অবিলম্বে এসব ধর্মদ্রোহী নাস্তিককে গ্রেফতার করে ফাঁসি দিতে হবে। ফাঁসি ব্যতীত কোনো শাস্তি তৌহিদি জনতা মেনে নেবে না। গতকাল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের উদ্যোগে শাহবাগের ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে বাদ জুমা চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের সামনে আয়োজিত মিছিল-পূর্ব বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন।
এদিকে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে লক্ষাধিক মুসল্লি ইসলাম ধর্ম ও রাসুলকে (সা:) নিয়ে ব্লগারদের কটূক্তির বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ চত্বর থেকে বের হয়ে আসে। মিছিলটি চেরাগীপাহাড় মোড়ে এসে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি অংশ লাভলেন হয়ে ওয়াসা মোড়ের দিকে অগ্রসর হয়। অপর অংশটি জামালখান প্রেস ক্লাবের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। তবে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা মিছিল নিয়ে সে দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
এ সময় প্রেস ক্লাবের সামনে গণজাগরণ মঞ্চে আগুন ও ভাংচুর করে মিছিলকারীরা।সেখানে টাঙানো বিভিন্ন ব্যানার ও সাময়িকভাবে স্থাপিত ম্যুরাল এবং সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ টয়লেট জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। তারা জামালখান মোড়ে স্থাপিত দুটি বিশাল নৌকা ভাংচুর শেষে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এ সময় বিক্ষোভ মিছিলের ছবি তুলতে গেলে কয়েকজন সাংবাদিককে তারা লাঞ্ছিত করে। এতে দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র ফটোসাংবাদিক কুতুব উদ্দিন ও দৈনিক যুগান্তরের ফটোসাংবাদিক রাজেশ চক্রবর্তী আহত হন। বিক্ষোভকারীদের হাতে লাঞ্ছিত সাংবাদিকদের মধ্যে আরও রয়েছেন এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান ফরিদ উদ্দিন, এটিএন নিউজের ক্যামেরাম্যান অমিত দাশ, বাংলাভিশনের ক্যামেরাম্যান পলাশ, মাছরাঙা টিভির আলমগীর টিপু ও দৈনিক বণিক বার্তার রিপোর্টার ওমর ফারুক।
খুলনায় পুলিশ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের গুলিতে আহত দেড়শতাধিক : খুলনায় জেলা ইমাম পরিষদের মিছিলে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ এবং যুবলীগ-ছাত্রলীগের হামলায় অন্তত দেড়শতাধিক মুসল্লি আহত হয়েছেন।গুলিবিদ্ধ হয়েছেন শতাধিক মুসল্লি। তাদের মধ্যে জুয়েল (৩০), মামুন অর রশিদ (৩০), নুরুল জামান (৩৫), নাজমুল হোসেন (২৫) ও বেল্লালকে (১৮) আশঙ্কাজনক অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া আহত অসংখ্য মুসল্লি নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিকে গোপনে চিকিত্সা নিচ্ছেন। গতকাল বিকালে নগরীর শিববাড়ী মোড় থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত—যা এক পর্যায়ে নগরীর খান এ সবুর রোড, কেডিএ এভিনিউ ও নিউমার্কেট এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ মোট ৭ শতাধিক রাউন্ড গুলি ও শতাধিক রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে যুবলীগ-ছাত্রলীগ ক্যাডাররা শিববাড়ী মোড়ে পৌঁছায় এবং রামদা, রড, চাপাতি, ককটেল নিয়ে রাস্তায় নেমে পুলিশের পাশাপাশি মুসল্লিদের খুঁজে খুঁজে বেদম মারপিট করে। এসময় তারা বোমা ও পিস্তল দিয়ে গুলি করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডারদের দফায় দফায় গুলিবর্ষণ এবং বোমা বিস্ফোরণে নগরী প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। তারা নগরীর শেখপাড়া ও ডাল মিল এলাকায় বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর দুটি অফিস ভাঙচুর করে। হামলা করে ইসলামী ব্যাংকের কেডিএ শাখা ও এটিএম বুথে। শিববাড়ী মোড়ের স্কাই ভিউ হোটেলটি পুলিশের সহায়তায় ভাঙচুর করেছে যুবলীগ ক্যাডাররা। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ ৮ জনকে আটক করেছে বলে জানা গেছে।
গুলিবিদ্ধ মুসল্লিদের ক’জন হলেন—হাফেজ কুদ্দুস, মাওলানা সোয়ায়েব, হাফেজ শাহজাহান, মাওলানা আবুল হোসেন, মাওলানা নুরুল ইসলাম, মাওলানা সাইফুল, মাওলানা তুহিন, হাফেজ আরমান, হাফেজ রইজ উদ্দিন, মাওলানা রিয়াজুল ইসলাম, মাওলানা গোলাম ফারুক, মাওলানা মহিবুল্লাহ, মাওলানা শাকের উদ্দিন, মাওলানা নাসির মাহমুদ, মাওলানা হাফিজুর রহমান প্রমুখ।
রাজশাহী রণক্ষেত্র, ১০ গুলিবিদ্ধসহ আহত শতাধিক : গতকাল দুপুরে রাজশাহীতে ইসলামী সমমনা ১২ দল ও আলেমসমাজ-মুসল্লিদের বিক্ষোভ-সমাবেশে ছাত্রলীগ-পুলিশের হামলা এবং দফায় দফায় সংঘর্ষে রাজশাহী রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। জুমার নামাজের পর দুপুর সোয়া ২টার দিকে নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট এলাকায় হেফাজতে ইসলাম, ইমান-আকিদা হেফাজত কমিটি ও সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ কমিটির ব্যানারে আলেমসমাজ এবং সাধারণ মুসল্লিরা মিছিল বের করলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মুসল্লিদের ওপর অতর্কিত হামলা, ককটেল, শটগানের গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ারশেলসহ সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে দফায় দফায় সংঘর্ষে গোটা নগরী রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় উত্তেজিত মুসল্লিরা নগরীর আলুপট্টি এলাকার প্রজন্ম চত্বর ভাঙচুর করে।পরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পুলিশের সামনেই ইসলামী ব্যাংকে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় উত্তেজিত মুসল্লিরা রাজশাহীর মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে লাঞ্ছিত এবং তার গাড়ি ভাঙচুর করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ-র্যাব মুসল্লিদের ওপর সহস্রাধিক শটগানের গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ারশেলসহ সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে গোটা নগরী প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।পুলিশ মুসল্লিদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। পুলিশ ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা থেকে সোনাদীঘি মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা শেখ তৈয়বুর রহমান নিজামী এবং দরগা মসজিদের ইমাম মোস্তাফিজুর রহমানসহ অর্ধশত মুসল্লিকে আটক করে। আটকের পর পুলিশ তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ইসলামী সমমনা ১২ দল, আলেমসমাজ ও মুসল্লিদের মিছিল-সমাবেশ ঠেকাতে সকাল থেকেই পুলিশের রণপ্রস্তুতিতে গোটা নগরীতে এক ধরনের যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী জুমার নামাজের পর নগরীর চারদিক থেকে বিভিন্ন মসজিদ থেকে সাহেববাজার জিরো পয়েন্টের দিকে শত শত মিছিল আসতে থাকে। দুপুর সোয়া ২টার দিকে লক্ষাধিক মুসল্লির সমাবেশের প্রস্তুতি চলছিল। এমন সময় নগরীর তালাইমারী থেকে আসা মুসল্লিদের মিছিলে আলুপট্টি ও কুমারপাড়া এলাকায় ছাত্রলীগের হামলার খবরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। মুসল্লিরা অভিযোগ করে বলেন, রাসিক মেয়রের নেতৃত্বে মহানগর আ.লীগ অফিস থেকে পুলিশের সহায়তায় ছাত্রলীগ আলেমসমাজের ওপর হামলা চালালে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পরে বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা নগরীর আলুপট্টিতে নতুন প্রজন্মের জাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেয়।পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় এক হাজার রাউন্ড শটগানের গুলি, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এদিকে নগরীর আলুপট্টি এলাকায় বার্তা ভবনে ছাত্রলীগ হামলা চালিয়ে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় ব্যাপক ভাঙচুর করে। পরে তারা ব্যাংকের প্রধান ফটকে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ইসলামী ব্যাংকের কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
সংঘর্ষ চলাকালে ১৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে বলে দাবি করেছেন মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন। তবে এ ঘটনায় কোনো পুলিশ সদস্য আহত হননি বলে দাবি করেছেন রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার এসএম মনির-উজ-জামান। এছাড়া সংঘর্ষে ১০ জন গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক মুসল্লি আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন ইসলামী ও সমমনা দলের নেতারা।
পাবনায় আহত ৫০, আজ আধাবেলা হরতাল : রাসুল (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তিকারীদের বিচারের দাবিতে গতকাল পাবনার প্রতিটি মসজিদের মুসল্লি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এসময় পুলিশের লাঠিচার্জে কমপক্ষে ৫০ জন আহত হন। জামায়াত ও শিবির অফিসে অগ্নিসংযোগ করে ব্যাপক লুটতরাজ এবং স্থানীয় একটি পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয় যুবলীগ-ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। ফোকাস, রেটিনা, রাডার কোচিং ও অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ এহিয়ার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করা হয়।সন্ধ্যায় মাওলানা আবদুস সুবহানের বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। পুলিশ এসময় নীরব দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে থাকে। এতে প্রায় ১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দলীয় সূত্র দাবি করেছে। পুলিশ বিভিন্ন স্থান হতে প্রায় ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে। এসব ঘটনার প্রতিবাদে আজ শনিবার আধাবেলা হরতাল ডেকেছে পাবনা জেলা জামায়াতে ইসলামী। জেলা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলানা জহুরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি অধ্যাপক আবু তালেব মণ্ডল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ হরতাল আহ্বান করেন। অপরদিকে পাবনার মধুপুর, পুষ্পপাড়া, বাংগাবাড়ীয়া, ধোপাঘাটা, জালালপুর থেকে প্রায় ২০ হাজার মুসল্লি মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
বগুড়ায় মুসল্লিদের ওপর পুলিশের হামলা : বগুড়ায় জুমার নামাজের পর মিছিল বের করলে পুলিশ মুসল্লিদের ওপর হামলা করে। এতে দু’পক্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।এসময় গণজাগরণ মঞ্চ ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে শতাধিক রাউন্ড গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে পুলিশ।ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হয়েছেন। পুলিশ এ ঘটনায় ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে।
২৩ ফেব্রুয়ারী/নিউজরুম